সম্পর্কের দেয়াল পর্ব-১৫+১৬

0
362

#সম্পর্কের__দেয়াল
#Writer_AnaHita_Ayat_SumaiYa
#পর্ব__১৫
পরের দিন সকাল হতেই সব প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র নিয়ে বাড়ির বাহিরে চলে আসে রিধি আর তার বাবা মা। তাদের স্থান ত্যাগ করতে দেখে অলরেডি পাড়া প্রতিবেশী রা হাজির। কয়েকজন তো কানাঘুষা ও শুরু করেছে। কিন্তু রিধি আর তার বাবা মায়ের কোনো উত্তর নেই। শেষ বার বাড়ি টার দিকে একবার ফিরে তাকালো ৩ জন। অনেক পুরোনো স্মৃতি এই বাড়ি কে ঘিরে রয়েছে। সেই সব সুখময় স্মৃতি কে দুঃখের গ্লানি থেকে বাঁচতে পিছনে ফেলে সামনে অগ্রসর হতে হচ্ছে তাদের। সময় মানুষের জীবন কে ঠিক কখন কোথায় নিয়ে দাঁড় করায় বা করাবে এটা মানুষ ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারে না। প্রত্যেক মানুষ কে ঘিরে গড়ে উঠে একটা গল্প! আর সময় সেই গল্প কে মাঝে মাঝে নিয়ে দাঁড় করায় সুখের মুহুর্তে আবার কখনো বা দুঃখের গ্লানি তে। মানুষ বরাবর ই দুঃখ কাতর। কথায় বলে মানুষ অতি দুঃখে কাতর আর কঠিন দুঃখে পাথর। দুঃখ তো দুঃখ-ই! সুখ কে মানুষ খুব সহজে যেভাবে অনুভব ও উপভোগ করতে পারে ঠিক তেমন করে দুঃখ কে তারা অতো টা সহজে গ্রহণ করতে পারে না। ফলে দুঃখ মানুষের জীবন কে নষ্ট করে দেয়! তাই বলে এই নয় যে মানুষের জীবনে দুঃখ থাকতে পারবে! মূলত দুঃখ আছে বলেই মানুষ সুখ কে এতো সুন্দর করে উপলব্ধি করতে পারে। সুখ বিনে দুঃখ, দুঃখ বিনে সুখ পুরোপুরি অচল ও একঘেঁয়ে!

কয়েক ফোঁটা চোখের পানি রিধির চোখ থেকে শেষ বারের মতো ঝরে পড়ে। রিধির বাবা মা পাথরের মতো হয়ে আছেন। তারা রিধি কে কাঁদতে বারণ ও করছেন না কারণ তারা চান রিধি কান্না করুক। কাঁদলে মন ফ্রেশ হয়। এবং উনাদের বিশ্বাস রিধি এই কান্না থেকেই নিজেকে শক্ত করার সূচনা ঘটাবে। উপসংহার ওবধি যাতে রিধি কে আর কাঁদতে না হয় এই জন্য ই…..

ভালোবাসা ও প্রাণের শহর ছেড়ে অনেক দূরের পানে পাড়ি জমায় রিধি ও তার বাবা মা। সব মানুষ তো আর খারাপ নয়। পরিবার টার জন্য কয়েক জন আফসোসের সঙ্গে বলছেন,
‘ওরা এমন না করলে ও পারতো!’

আবার কারো বা মত ভিন্ন!
‘চলে গেছে ভালো করেছে। এখানে থেকে মানুষের কটু কথা শোনার থেকে দূরে গিয়ে কষ্টে থাকা ও অনেক ভালো।’

‘হ্যাঁ ঠিক বলেছো। নতুন ঠিকানায় গেলে হয়তো ক’দিন, ক’মাস বা বড়জোড় ক’বছর কষ্ট পাবে তারপর তো সব ঠিক ই ভুলে গিয়ে ভালো থাকবে। আর এখানে থাকলে আশে পাশের খারাপ মানুষ গুলো বার বার পুরোনো ক্ষত কে সামনে টেনে নিয়ে আসবে।’

‘থাক এখন আর আফসোস করে কি হবে!’

এভাবেই অনেকে আফসোস করতে করতে বাড়ি চলে যায়।

————————-
রাতে আর পাভেলের মা রিধি দের খোঁজ খবর রাখলেন না কারণ উনি ভেবেছিলেন সকালে এক বার ওদের বাড়ি যাবেন ফোনে কথা বলার চেয়ে বাড়ি গিয়ে সরাসরি কথা বলা শ্রেয়। যেই ভাবা সেই কাজ রাতে আর কিছু করলেন না। চিন্তা করতে করতে অনেক রাত ওবধি উনার ঘুম আসে নি। এক পর্যায়ে কখন ঘুমিয়ে যান নিজেও টের পান নি। অনেক সকালে ঘুম ভাঙ্গে তার! এতো দেরি কিভাবে হয়ে গেলো বুঝতে পারলেন না। উঠে ফ্রেশ হয়ে নিচে গিয়ে দেখে কেউ নেই।

পাভেল আর রিমি কোথায় সেটাই তিনি ভাবছিলেন। নিচে আসতেই লক্ষ্য করলেন পাভেল রান্না ঘর থেকে বেরোচ্ছে। ক্ষণিকের মধ্যে রাগ উঠে গেলো! উনি চোখ গরম করে ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন,
‘পাভেল??’

‘হ্যাঁ মা উঠেছো তুমি? আসো নাস্তা করতে দেখো তোমার নতুন বউ মা কি বানিয়েছে আজ!’

পাভেলের হাসি খুশি চেহারা। খুব সম্ভবত স্বার্থপর মানুষ গুলো এমন ই হয়। একজন কে দুঃখের নোনাজলে ভাসিয়ে দিয়ে তারা সুখে আর আরামসে দিন কাটায়। পাভেল ও সেই মানুষ গুলোর দলের ই একজন!

‘তুই রান্না ঘরে কেন গিয়েছিস?’

‘কেন মা কোনো সমস্যা?’

‘ছেলেদের রান্না ঘরে যেতে নেই জানিস না! আমাদের বংশে কোনো ছেলে কখনো রান্না ঘরে যায় নি। ছেলেদের কাজ বাহিরে রান্নাঘরে নয়!’

‘কেন যেতে নেই? ছেলেরা কি শুধু বাহিরের কাজ করবে!’

‘হ্যাঁ!’

‘আমি এই নিয়ম মানি না!’

‘পাভেললল…!’

রিমি সব শুনে দুজনার মাঝখানে এসে বললো‌‌‌,
‘আচ্ছা মা আজ ভুল হয়ে গেছে পাভেলের হয়ে আমি মাফ চাচ্ছি স্যরি!’

পাভেল কিছু বলতে যাবে রিমি নিষেধ করে দেয়। পাভেলের মা দাঁতে দাঁত চেপে আর কিছু বললেন না। রিমির বানানো নাস্তা খেতে তার এক দন্ড ও ইচ্ছা হলো না। কিন্তু এই মুহুর্তে আর কিছু করার ও নেই তাই তিনি কোনো ভাবে অল্প কিছু খেয়েই উঠে নিজের ঘরে চলে যান। পাভেল তা দেখলো!

‘মা খেয়ে যাও! রাগ আমার উপর খাবার তো কিছু করে নি তাই না?’

‘আমার খাওয়া শেষ..!

নিজের রুমে গিয়ে যথারীতি উনি তৈরি হয়ে নেন রিধির বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে। ড্রয়িংরুমে পাভেল আর রিমি বসা ছিলো। রিমি পাভেলের মা কে দেখে বুঝতে পারলো উনি কোথাও যাওয়ার জন্য তৈরি হয়েছে! কিন্তু এটা বুঝতে পারলো না কোথায় যাচ্ছে এই সময়ে! তাই রিমি বললো,

‘মা কোথাও যাচ্ছেন?’

পাভেল রিমির কথা শুনে তার মায়ের দিকে তাকায়। রিমির মতো এখন তার মাথায় ও সেইম প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকলো! তার মা যাচ্ছে টা কোথায়?

‘কি হলো মা চুপ করে আছো যে! বলবে তো কোথায় যাচ্ছো এই সাত সকালে!’

‘আমার যেখানে ইচ্ছা যাবো এখন কি সেক্ষেত্রে আমার তোদের থেকে অনুমতি নিতে হবে নাকি?’

পাভেল বুঝতে পারলো তার মা এখনো তাদের উপর পুরোপুরি রেগে আছে তাই সে তার মায়ের কাছে এগিয়ে এসে মায়ের দুই হাত ধরে বললো,

‘মা প্লিজ এবার তো সব ভুলে যাও! কেন অযথা রাগ দেখাচ্ছো?’

‘তুই ভুলে গেলেও আমি কিছু ভুলতে পারবো না!’

রেগে তিনি হনহন করে হেঁটে চলে যায় বাড়ির বাহিরে। পাভেল ঠায় দাঁড়িয়ে তা দেখছিলো শুধু। রিমি মন খারাপ করে এগিয়ে আসে পাভেলের দিকে। মাথা নিচু করে বললো,

‘তোমার মা আমাকে মানবেন না তাই না পাভেল?’

পাভেল এবার রিমির দিকে ফিরে তাকায়। রিমির মুখে ছোট হয়ে আছে। আর সে নিচের দিকে তাকিয়েই পাভেল কে এই কথা টা বলেছে। পাভেল রিমির দু গালে আলতো করে হাত রেখে হেসে বললো,

‘এমন কিছু না। মা একটু রেগে আছে তুমি মায়ের মন জয় করে নাও দেখবা সব ঠিক হয়ে গেছে!’

‘কিন্তু!’

‘কোনো কিন্তু নয় এখন এখানে বসো তো!’

পাভেল রিমি কে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়। আর পাভেলের মা সোজা রিমিদের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। রিমির মাথায় ঘুরতে থাকে পাভেলের মা কোথায় যাচ্ছে তা নিয়ে হাজারো চিন্তা! পাভেল কাছে আছে ঠিকই কিন্তু রিমির মন অন্য দিকে!

প্রায় ১ ঘন্টা পর পাভেলের মা রিধিদের বাড়ি তে আসে। উনি দেখেন সব কিছু নিরিবিলি। আশে পাশের পরিবেশ টা শুনশান আর একেবারে স্তব্ধ। মনে কোনো মানুষ জন নেই এখানে। পাভেলের মা গেট ক্রস করে বাড়িতে ঢুকে দরজায় তালা মারা দেখতে পেলেন। আর একটাও নয় ৩ টা। পাভেলের মা কিছু টা আন্দাজ করতে পেরে এদিক ওদিক হকচকিয়ে তাকাতে লাগলেন। কাউকে দেখতে না পেয়ে পুরো বাড়ির আশেপাশে পাশে ঘুরতে থাকেন। অতো ঘুরে ও কাউকে পাওয়া তো দূরের কথা কারো কথা ওবধি শুনতে পেলেন না। পাভেলের মা কে দেখে রিধিদের প্রতিবেশী কুসুম বানু এগিয়ে আসে।

‘আপনি রিধির শাশুড়ি না?’

‘হ্যাঁ কিন্তু ওরা কোথায়? কাউকে দেখছি না যে কোথাও গিয়েছে?’

কুসুম কেঁদে উঠলো,

‘আর বলবেন না। রিধি তা আজ সকালে এই বাড়ি ছেড়ে কোথায় যেনো চলে গেছে!’

পাভেলের মা হতভম্ব হয়ে জবাব দেন…
‘কিহহহ…!

‘হ্যাঁ সত্যি.(তারপর কুসুম পাভেলের মা কে সব খুলে বলে সকালের ঘটনা! পাভেলের মা সব শুনে মনে বেশ দুঃখ পান।)

‘কোথায় গেছে বলতে পারো?’

‘কাউকে কিছু বলে যায় নি! তাই আমরা এই সম্পর্কে কিছুই জানিনা!’

পাভেলের মা এক পর্যায়ে নিরাশ হয়ে পড়েন। মন উত্তাল পাতাল ঝড় বয়ে যায়। মনে হচ্ছে রিধি কে তিনি সারাজীবনের জন্যই হারিয়েছেন। নিজেকে নিজে ধিক্কার দিতে থাকলেন রাতে কেন এলেন না তিনি তাহলে তো পেতে পারতেন! হতাশার চরম পর্যায়ে গিয়ে সূর্যের আলোর মতো রিধিদের খোঁজ পাওয়ার একটা উপায় উদিত হলো। তিনি ঝটপট রিধি কে কল দেওয়ার জন্য ফোন টা বের করতে গিয়ে দেখেন তাড়াহুড়ো তে তিনি ফোন সাথে করে নিয়ে আসতেই ভুলে গেছেন! এবার উনার রাগের মাত্রা চরম পর্যায়ে গিয়ে ঠেকলো!

তিনি দ্রত বাড়ি যাওয়ার জন্য পা বাড়ান।‌ কেননা উনার মনে হচ্ছে আর একটু দেরি হলে এই‌ শেষ আশার আলো টাও নিভে যাবে।

অন্যদিকে গাড়ি তে বসে আছে রিধি আর রিধির বাবা মা। আত্নীয় স্বজন রাও কটু কথা শোনাতে বাদ রাখে নি। ফোন কলে সবাই ঝেড়েছেন। গাড়ি তে উঠা থেকে নিয়ে শ’ খানেক কল এসেছে ফোনে। এক পর্যায়ে রিধির রেগে গিয়ে ৩ টা ফোন থেকেই সিম ৩ টা খুলে ভেঙ্গে চুরমার করে রাস্তায় ছুড়ে মারে। ব্যাস কাহিনী খতম। যে আত্নীয় রা এই খারাপ সময়ে কথা শোনাতে দু বার ভাবলো না তাদদর সাথে যোগাযোগের কোনো দরকার নেই। সব কিছুর ইতি টেনে দিলো রিধি! নতুন করে সূত্রপাত ঘটাবে বলে…. এবার যা হবে ভালোর জন্য-ই হবে খারাপ আর কিছুই হবে না!… অবশ্য খারাপ তো যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে আর কি ই বা বাকি আছে!

রিধি কানে এয়ার ফোন লাগিয়ে আনমনে অন্যদিকে তাকিয়ে একটা গান প্লে করে দেয়। গান টা বাজতে শুরু করে। গানের কথা গুলো এমন…

ভালোবেসেছি তোমায় যত
আজ মনে ঠিক ততই ক্ষত,

ছিলো যে হৃদয় পরিপাটি
আজ সে হৃদয় পোড়া মাটি!

কি হবার ছিলো কি হয়ে গেলো,
ভালোবেসে মন কি পেল!……

প্রত্যেক টা কথা যেনো পাভেল কে ঘিরে রিধির মন বলছে। চোখ বন্ধ করে গান টা অনুভব করা কালিন কয়েক ফোঁটা চোখের পানি আবারো গড়িয়ে পড়লো রিধির চোখ থেকে। কারণ প্রত্যেক কথা সত্য! পাভেল কেও রিধি ভালোবেসেছিলো! কিন্তু পাভেল তার ভালোবাসার এই মূল্য দিবে ভাবে নি কখনো! এই জন্যই বলে সত্যি কারের ভালোবাসা সবার কপালে সয় না! ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করে রিধি কিছু একটা হলো সে চোখ খুলে রেগে গিয়ে গান টা বন্ধ করে দিলো। শুধু বন্ধ করাতেই সীমাবদ্ধ থাকলো না রিধি গান টা ফোন থেকেই ডিরেক্টলি ডিলেট করে দিলো। নিজেকে কঠোর ও স্ট্রং করে নিজেই নিজের মন কে বললো ঠিক এভাবেই সে পাভেল কেও তার থেকে পারমানেন্টলি ডিলেট করে দিবে! কারণ পাভেল তার অযোগ্য!

—————–

পাভেল রিমি কে নিয়ে খুনসুটি তে ব্যস্ত ছিলো হঠাৎ করে তার ফোন টা বেজে উঠে। কে কল করেছে তা দেখে পাভেল আচমকা অপ্রস্তুত ভাবে ফোন টা রিসিভ করে কানের সাথে চেপে ধরলো। এরপর সে ওপাশ থেকে যা শুনলো তাতে পাভেলের হাসি খুশি মুহুর্তেই গায়েব হয়ে গেলো। আর সে মুষড়ে পড়লো….

চলবে__________________

#সম্পর্কের__দেয়াল
#Writer_AnaHita_Ayat_SumaiYa
#পর্ব__১৬
পাভেলের হাত থেকে ফোন টা পরে যায়। হতাশাগ্রস্থ হয়ে সে সোফার উপর ধফাস করে বসে পড়ে। রিমি তো খুব অবাক। বুঝে উঠতে পারলো না ঠিক ওর ক্ষণিকের মধ্যে কি হয়ে গেলো যে তাকে এতো নিরাশ দেখাচ্ছে।
‘পাভেল কি হয়েছে কোনো খারাপ খবর?’ দুই বাহু ধরে ধাক্কা দিয়ে কথা টা বলে সে। অপরদিকে যার দিকে সে প্রশ্ন ছুঁড়েছে ও ভাবলেশহীন মানুষ এর মতো একদম ঘাপটি মেরে মুখে তালা দিয়ে বসে আছে। কোনো উত্তর না পেয়ে ফের প্রশ্ন ছুঁড়তে হলো,

‘আরে চুপ করে থাকলে বুঝবো কিভাবে আমি তোমার কি হয়েছে? প্লিজ চুপ করে থেকো না বলো আমাকে কি হয়েছে!’

অনেক রিকোয়েস্ট এর পর মানুষ টা বুঝলো তার আর চুপ করে থাকা উচিত নয়। তাই বাধ্য হয়ে মুখ খুললো,

‘আমার.. (বলে একটু থামলো)

‘হ্যাঁ তোমার তারপর কি? বলো…

‘আমার চাকরি টা চলে গেছে রিমি!’

‘কিহহহ….

পাভেল চুপ করে থম মেরে রইল। রিমি কথা টা মস্তিষ্কে পৌঁছানোর পর, একের পর এক প্রশ্ন মনে জাগতে লাগলো। যেটা বেশি আসছে সেটা হলো,

‘হঠাৎ করে চাকরি চলে যাওয়ার মানে কি? কোনো রিজন তো অবশ্যই আছে তাই না! খুলে বলো আমাকে প্লিজ!’

‘রিজন তো তুমি!’

‘হোয়াট? পাভেল আর ইউ ম্যাড?’

‘না আমি পাগল নই। আর যা বললাম কোনো ভুল বলিনি!’

‘আজব! আমি না কিছু বুঝতে পারলাম না তুমি ঠিক কি বলছো! ক্লিয়ার করে বলবে সব?’

‘ঐ সেদিন বলেছিলাম না আমার অফিসের জরুরি একটা ডিল ফাইনাল করতে যেতে হবে।’

‘হুম তো…

‘তোমাকে নিয়ে আসতে গিয়ে আমি সেই মিটিং এ তো আর এটেন্ড করতে পারিনি। আমার মাথা থেকে সেদিন এই কথা টা বেরিয়ে গিয়েছিলো যে বস বলেছিলো এই ডিল কোম্পানির জন্য কতো টা গুরুত্বপূর্ণ। যদি কোনো ভাবে ওই ডিল হাত থেকে বেরিয়ে যায় তাহলে আমার চাকরি খুইয়ে ফেলার সম্ভাবনা আছে! আমি এই কথাটার গুরুত্ব দেই নি সেদিন অনেক টেনশন আর চাপের জন্য বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম সব!’

‘কিন্তু এখন…. এ্ এখন কি হবে পাভেল?’

‘আমার জানা নেই কি হবে!’

‘বস কে কোনো ভাবে বলে মানানির চেষ্টা তো করো!’

‘সম্ভব না। তিনি মুখের উপর না করে দিয়েছেন!’

‘এভাবে হুট করে চাকরি চলে গেলে আমরা খাবো কি? কিছু তো করা উচিত তাই না! করো না কিছু একটা!’

রিমির কথায় পাভেলের রাগ হলো কিছু টা। সে তাকে ধমক দিয়ে বললো,

‘তোমার মাথা আর মুন্ডু করবো আমি হ্যাঁ?’

‘পা…ভে…ল…

এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পাভেল ভীষণ ভাবে ভেঙ্গে পড়ে। সুখের সময় স্পেন্ড করতে নিয়েছিলো আর ঠিক তক্ষুনি এই এত্তো বড় একটা স্যাড নিউজ। সব কিছু উলট পালট করে দেওয়ার জন্য তো এটা যথেষ্ট বটেই। পাভেল সেই এক ভাবে বসেই আছে আর রিমি অতিরিক্ত চিন্তা টেনশন আর পাভেলের ধমক খেয়ে কান্না শুরু করে দিয়েছে। পাভেল একটু বেশি ডিপ্রেস্ড কারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য একটা ভালো চাকরি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর এখন কার সময়ে একটা চাকরি ফের জোগাড় করা খুব জটিল কাজ। কারোই মাথায় আসছে না এখন কি হবে!

পাভেলের মা বাড়িতে এসে দেখে দুই জনার মন ভার। কিন্তু হওয়ার কথা ছিল উল্টো টা! তিনি কিছু টা আঁচ করতে চেষ্টা করলেন কি কিন্তু সফল হলেন না। তিনি সোজা রুমে চলে যান। মাথায় হাত দিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলেন। তারপর উঠে জলদি ফোন টা খুঁজতে থাককেন। সারা ঘর খুঁজে ও তিনি ফোন টা কে কোথায় না পাওয়ায় মাথা গরম হয়ে যায়। রুম থেকে নিচে বসে থাকা মানুষ দুটির উদ্দেশ্যে কথা ছুঁড়তে থাকেন,

‘আমার ফোন টা কই পাচ্ছি না? হঠাৎ করে ফোন টার কি পা গজিয়ে গেছে যে হেটে হেটে কোথাও চলে গেলো?’

তিনি চিল্লাতে চিল্লাতে নিচে আসেন। একে তো চাকরির টেনশন তার উপর পাভেলের মায়ের এই চিল্লানো মাথা খারাপ করে দেয়ার মতো অবস্থা। উনি একাই কথা বলে যাচ্ছেন ঠিকই কিন্তু কোনো উত্তর পাচ্ছেন না। এতে রাগ বাড়িয়ে দিলো যেনো,

‘চুপ করে আছিস কেন দুই জন?’

পাভেল উচু স্বরে বললো,
‘কি সমস্যা মা চিল্লিয়ে কানের পর্দা ফাটিয়ে দিবা দেখছি!’

‘তো তাহলে বোবার মতো বসে না থেকে জবাব দিলেই তো পারিস!’

‘কি জবাব দিবো?’

‘আমার ফোন কোথায়?’

‘নিজের খেয়াল ই রাখতে পারি না আবার তোমার ফোন…

‘কি বললি তুই?’

পাভেল উঠে হনহন করে চলে যায় দেখে রিমি এগিয়ে আসে মা কে সে বললো,

‘মা এখন ফোন দিয়ে কি করবেন?’

‘আমি আমার ফোন দিয়ে যাই করি না কেন সেই কৈফিয়ত কি এখন থেকে আমার তোকে দিতে হবে?’ (রেগে চোখ রাঙিয়ে বললেন)

‘আমি কিন্তু সেটা একবার ও বলিনি….

‘তুই কি বলতে চেয়েছিস আমি ভালো করেই বুঝেছি! আমি তো আর দুধের বাচ্চা না!’

‘মা আস্তে কথা বলুন আমি এক্ষুনি খুঁজে নিয়ে আসছি!’

‘শোন তুই আমাকে মা ডাকবি না। ওইসব দিয়ে পাভেল কে ভোলাতে পারলেও আমাকে তুই ভোলাতে পারবি না কথা টা কান খুলে শুনে রাখ! আমার ফোন নিয়ে আয় জলদি!’

রিমি দাঁতে দাঁত চেপে পাভেলের মায়ের দিকে তাকালে দুজনার চোখাচোখি হয়ে যায়।

‘কি হলো যাচ্ছিস না কেন?’

আর কোনো কথা না বলে হনহনিয়ে রেগে রিমি ও রুমে চলে যায়। সব ক টা রুম খুঁজে অবশেষে ফোন টা পায় সে। বিছানার উপর সজোরে একটা আছাড় মেরে নিজেই নিজেকে বলে বসলো,

‘এই বুড়ি টা বড্ড বেড়ে যাচ্ছে। পেয়েছে কি আমাকে হ্যাঁ? ভালো ভাবে কথা বলছি তাই বলে এই ভাষা এই ব্যবহার উনার? অতি বাড় মোটেও ভালো নয়!’

রাগ চরমে পৌঁছে যায়।
‘কন্ট্রোল রিমি কন্ট্রোল! এতো অল্পতে অতিষ্ঠ হয়ে গেলে তো চলবে না তোকে!'(মনে মনে)

চুপচাপ ফোন টা নিয়ে নিচে যায় সে। তার শাশুড়ি নিচে বসে সাপের মতো রেগে ফুঁসছেন। চোখে মুখে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি। নিজেকে শান্ত করে কোমল কন্ঠে বললো,

‘এই নিন মা আপনার ফোন!’

‘কোথায় পেলি?’

‘আপনার রুমেই…

‘মিথ্যা বলবি না একদম।’

‘না সত্যি বলছি!’

‘তাহলে আমি পেলাম না কেন রে? খবরদার সাহস বাড়িয়ে আর কখনো আমার ফোনে হাত দিবি না!’

এই বলে পাভেলের মা সিড়ি বেয়ে তড়িঘড়ি করে নিজের ঘরের দিকে চলে যায়। উনার কথা শুনে বিপরীতে থাকা মানুষ টার মেজাজ প্রচন্ড খারাপ হয়ে গেলো। কারণ সে যতই ভালো চাচ্ছে ততই খারাপ মনোভাব প্রকাশ করছে এই মহিলা! হঠাৎ ফোনের পিছনে এমন গুরুতর ভাবে লাগল কেন এমন একটা প্রশ্ন মনে জেগে উঠলো। রিমি ও উনার পিছন পিছন উপরে যায়। পাভেলের মা কারো পায়ের শব্দ বুঝতে পেরে সেই ব্যক্তিটির মুখের উপর ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দেয়। এতে করে রিমি বেশ অপমান বোধ করতে লাগল। তার এই বাজে বিহেব টা ঠিক ভাবে হজম করা গেলো না!

তাছাড়া পাভেলের মা ওদের দুজনের চিন্তিত মুখ দেখে একবার ও জিঙ্গেস ওবধি করে জানতে চায় নি যে কি হয়েছে? আসার পর থেকেই কেবল ফোনের পিছনে পড়ে আছে এটা সেটা কথা শোনাচ্ছে তাই হালকা একটা সন্দেহের কীট মনে জাগলো রিমির। তাই ঠিক করলো আজ যে করেই হোক তার শাশুড়ি মা ফোন দিয়ে করে টা কি সে অবশ্যই দেখবে! হোক সেটা যে কোনো ভাবে!

শাশুড়ি মায়ের কথা ছেড়ে এবার পাভেলের কথা ভাবতে লাগলো সে। গেলো কোথায় পাভেল? ফোন খোঁজার সময় তো রুম সব কটা খুঁজেছে কই কোথাও তো দেখে নি তাকে! তাই রুমে আবার না খুঁজে সে সোজা ছাঁদে চলে যায়। তার মতে এখানেই আছে এটলিস্ট সে বাড়ির বাহিরে তো যায় নি!

——————————–

পাভেলের মা দরজা বন্ধ করে বারান্দায় যান। আর দেরি না করে তিনি রিধির নাম্বারে কল দেওয়ার চেষ্টা করেন কিন্তু পারলেন না। ফোন যাওয়ার আগেই কেটে যাচ্ছে। বহু বার চেষ্টার পর ও যখন তিনি ব্যর্থ হলেন তখন হতাশ হয়ে এক পাশে রাখা চেয়ারের উপর বসে পড়েন। ভাবতে থাকেন কি করবেন এখন। তবে কি তিনি সারাজীবনের জন্য রিধি কে হারালেন। আর কখনো কি দেখা মিলবে না রিধির মুখ খানা। ভেতর থেকে একটা হাহাকার অনুভব করেন তিনি। মাথায় হাত দিয়ে চেয়ারের উপর বসে পড়েন সাথে সাথে!

রিধি কে হারানোর চাপা কষ্ট টা রূপ নেয় ভয়ানক এক রাগ হয়ে। তিনি এবার পাভেল আর রিমি কে খুঁজতে থাকে। বাড়ি টা শুনশান কারো কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে তিনি ছাদে চলে গেলেন। সেখানেই একসঙ্গে দুজন কেই পেয়ে গেলেন।

উনাকে ছাঁদে আসতে দেখে দুজনার মেজাজ আরো বিগড়ে যাওয়ার উপক্রম। তারা কোনো কথা বলবে তার আগেই তিনি বলা শুরু করলেন,

‘এবার খুশি হয়েছিস না তোরা? অবশ্য খুশি না হওয়ার মতো তো কিছু নেই তাই না। এবার তো তোদের দুই পা তুলে তাথা থই থই করে নাচা উচিত!’

এমনিতেই ডিপ্রেশনে চলে গেছিলো পাভেল তার উপর মায়ের এমন উদ্ভট কথার কোনো মানে কিছু বুঝে উঠতে পারলো না। পাভেল রেগে যাচ্ছে দেখে রিমি তাকে শান্ত করে নিজেই বললো,

‘এমন করে কেন বলছেন মা! আমরা নাচবো কেন চাকরি চলে গেছে পাভেলের এই সংবাদ শুনে কি কেউ নাচে?’

‘কিহহহ…

অনেক অবাক হলেন তিনি।

‘হ্যাঁ মা!’

কিছুক্ষণ চুপটি করে থাকার পর তিনি উচ্চস্বরে হো হো করে হেসে উঠলেন। উনার সামনে থাকা আরো দুজন ব্যক্তি তো হতভম্ব। মা কে কি জ্বিনে আছর করেছে এমন কিছু একটা চট করে মাথায় আসলো রিমির। দুজন কেই চুপ থাকতে দেখে উনি আবার বললেন,

‘তোদের বিনাশ শুরু হয়ে গেছে তাহলে? এটা তো হওয়ার ই ছিলো হাহাহা…’

‘মানে?’

‘তোরা রিধির সাথে অনেক বড় অন্যায় করেছিস। করেছিস অনেক বড় পাপ। সুখ স্বামী সন্তান সব কেড়ে নিয়ে বেচারি কে নিষ্য করে তোরা ভালো থাকবি ভেবেছিলি? তোদের জন্য ওরা বাড়ি পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে আর তোদের দিয়ে গেছে অভিশাপ। আর সেই অভিশাপেই তোদের ধ্বংস অনিবার্য!’

রিধি রা বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে শুনে রিমি আর পাভেল রিতিমত শক্ড। চোখ দুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। পাভেল ই এগিয়ে এসে বললো,

‘কি বলছো মা তুমি? মাথা ঠিক আছে তোমার?’

‘আমি ঠিক ই বলছি। ওরা চলে গেছে সব ছেড়ে। এই তো চেয়েছিস! যা ওরা তোদের চাওয়া পূরণ করেছে!’

অন্যজন মায়ের এই কথার বিরোধ করে বললো,

‘মা আমরা এটা চাই নি!’

‘এই মেয়ে তুই চুপ থাক। আর পাভেল তোকে বলছি শোন আসমানের চাঁদ হাতে পেয়ে ও পায়ে ঠেলে আবর্জনার স্তূপে ফেলে দিয়েছিস।আর যাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিস সে একটা অভাগী অলক্ষ্মী!’

‘মা…

‘হ্যাঁ হ্যাঁ এই মেয়ে টা অলক্ষুনে। আজ তোর চাকরি খেয়েছে কাল দেখা যাবে আমার আর তোর জীবন ও খেয়ে দিয়েছে দেখিস তুই!’

মা ছেলের ভালো কথা কাটাকাটি হয়। মায়ের কথা গুলো বেশ অপমানজনক থাকায় রিমি কাঁদতে কাঁদতে বললো,

‘ঠিক আছে আমি যেহুতু সব সমস্যার মূল তাই আমি ই চলে যাচ্ছি। পাভেলের জীবন থেকে… আপনি খুশি থাকুন মা!’

পাভেল কিছু বলার আগে রিমি দৌড়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। পাভেল আটকাতে নিলে তার মা তার পথে বাঁধা প্রদান করে। ছাঁদ থেকে রাস্তা স্পষ্ট দেখা যায়।রাস্তা দিয়ে পাভেল রিমি ছুটে চলে যাওয়ার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে দেখলো শুধু……!

চলবে___________________