স্নিগ্ধ প্রেমের সম্মোহন পর্ব-১২

0
1229

#স্নিগ্ধ_প্রেমের_সম্মোহন
–[পর্ব-১২]
লেখিকাঃ #সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা

গাড়ির হর্ণের তীব্র শব্দে কাঁচা ঘুম মূর্হতেই ভেঙ্গে যায়। মাথা চেপে ধরে পিটপিট করে চারিপাশে তাকাতেই সবার প্রথম পূর্ব ভাইয়ার অসহায় চাহনি নজরে আসে। এক ফালি সূর্যরশ্মি চোখমুখে পড়াতে গাড়ির কাচ লাগিয়ে দেই।
অতঃপর পূর্ব ভাইয়ার অস্থির কন্ঠস্বর কানে ভেসে আসে! তিনি বলছেন,,,

— দোল?ঠিক আছিস?তোর তো হটাৎ ঘুম ভেঙে গেলে শ্বাসকষ্ট হয়!

আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হলেও স্বাভাবিক কন্ঠে বলি,,,

— ঠিক আছি আমি!

তারপর কি হলো জানা নেই। পূর্ব ভাইয়া তার ডানপাশে থাকা গাড়ির ড্রাইভার কে উদ্দেশ্য করে বলল,,,

— ব্লাডি বিচ! এতো জোরে হর্ণ দেয়ার কি আছে? অপেক্ষা করতে না পারলে রাস্তায় গাড়ি নিয়ে নামিস কেনো?

ড্রাইভার কে দেখলাম চুপসে যাওয়া মুখ নিয়ে সরি বলে সাথে সাথে গাড়ি টান দেয়।
আমি বিরক্ত! প্রচন্ড বিরক্ত পূর্ব ভাইয়ার ওপর। সামান্য কারনে এভাবে বকার কি দরকার ছিলো?

তিনি তার সিটবেল্ট খুলে আমার কাছে এসে একটানে তার বুকের সাথে মিশিয়ে নেন। আমি কিছু বলতে নিবো তার আগেই একটা ঔষধ মুখ ঢুকিয়ে দিয়ে পানির বোতল সামনে ধরে।
চটজলদি পানি খেয়ে নিয়ে তার দিকে রাগী দৃষ্টি দেই।

তবে পূর্ব ভাইয়ার আমার চাহনিতে তেমন কোনো পরিবর্তন হলোনা। তিনি আমাকে বুকে জরীয়ে ধরেই গাড়ি স্টার্ট দেন।

আমি তার হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বলি,,,

— ছাড়ুনন! এভাবে ধরে আছেন কেনো?কই নিয়ে যাচ্ছেন?এভাবে কোচিং থেকে তুলে আনলেন কেনো?

বরাবরের মতো পূর্ব ভাইয়া এই নিয়ে দশবার রিপ্লাই করলেন না। কোনো উত্তর দিলেন না।
সকালে কোচিং শেষ হওয়ার পর বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে গাড়িতে উঠতে যাবো তখনই এই লোক কোথা থেকে উড়ে এসে আমায় কাঁধে তুলে নেয়!
বড় বড় পা ফেলে তার কালো গাড়িটির কাছে নিয়ে ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটটায় বসিয়ে দেন। আমার দিকে বেশ খানিকটা ঝুঁকে সিটবেল্ট লাগিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়েন!

সেই থেকে জিজ্ঞেস করছিলাম কই নিয়ে যাচ্ছেন?কেনো নিয়ে যাচ্ছেন?এভাবে তুলে আনলেন কেনো সবার সামনে থেকে?
কিন্তু আফসোস! ত্যাড়া এই বজ্জাত লোক একটা প্রশ্নেরও উত্তর দেননি!
পরিশেষে ক্লান্ত থাকায় সিটে হেলান দিয়ে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ি!

কোমড়ের কাছটায় শক্ত করে চেপে ধরে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়েছেন আমায় পূর্ব ভাই! নড়াচড়া করা অসম্ভব প্রায়। যতই নড়াচড়া করতে নিই তখন আগের তুলনায় আরো শক্ত করে চেপে ধরেন!

নির্জন এক জায়গাতে এসে গাড়ি থামান তিনি! চারপাশ টা নিস্তব্ধ! সবুজ গাছপালা দিয়ে আচ্ছাদিত এক জায়গা এটা!

এমন একটা প্লেস দেখে গায়ের লোম দাড়িয়ে যায়। এতোটা নিস্তব্ধ কেনো এখানে?
পূর্ব ভাইয়া কি আমায় মেরে ফেলবেন?মেরে এখানে কবর দিয়ে চলে যাবেন? কিন্তু আমার দোষটা কি?

তার দিকে তাকাতেই দেখলাম তিনি আমার দিকে ভ্রু কুচকে এক প্রকার বিরক্তিকর চাহনি দিয়ে তাকিয়ে আছেন। বিরক্ত মাখা কন্ঠে বললেন,,,,

— তোর চিন্তাধারার প্রশংসা করতে হয় দোল! তোকে আমি এখানে মেরে ফেলতে এনেছি, এই চিন্তাটা ব্রেনে আনলি কিভাবে?ডাফার একটা!

মেরে ফেলবেন না তা শুনে মনে প্রশান্তি আসে!
তবে পরক্ষনেই তার বুকে জোরে একটা কিল বসিয়ে দেই। তিনি ব্যাথায় চোখ মুখ কুঁচকানোর বদলে শব্দ করে হেসে দেন!
ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকাকালীন তিনি হাস্যরত অবস্থাতেই উত্তর দেন,,,

— তোর মার গুলো এতোটা সুইট কেনো?আহা… শান্তি লাগছে! আরো একবার দে!

হতবিহ্বল আমি! নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছি। ততক্ষণে তিনি তার মুখ আমার দিকপ এগিয়ে ঠোঁটের ওপর শব্দ করে চুমু খান! আরেকদফা শক খেয়ে আবারও নির্বাক বনে যাই!
পূর্ব ভাইয়া হাসছেন! তৃপ্তিকর হাসি!

আচানক কিছু মনে পড়তে আমি তার হাতে চিমটি দেই। গাড়ির দরজা খুলে বেড়িয়ে যেতেই পূর্ব ভাইয়া দৌড়ে বেড়িয়ে আসেন আমার পিছু পিছু!

আমি রাগান্বিত কন্ঠে বলি,,,

— খবরদার! একদম আমার পিছু পিছু আসবেন না আপনি।

এতে করে পূর্ব ভাই থামলেন না। দৌড়ে এসে আমার হাত চেপে ধরে গাড়ির সাথে আমার দুহাত চেপে ধরেন! আমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেই। এই লোকের দিকে একবার তাকালে আমার সব রাগ পানি হয়ে যাবে যা আমি কিছুতেই চাইনা! একদমই না!

পূর্ব ভাইয়া ফিচেল কন্ঠে বললেন,,,

— আমার দিকে তাকা দোল!

আমি শক্ত কন্ঠে বলি, ‘না। ‘

— কেন কি সমস্যা? আমার মুখ দেখলে কি তোর সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাবে?নাকি তোর চোখ নষ্ট হবে?

— বলতে বাধ্য নই!

পূর্ব ভাইয়া আমার দুহাত আরো শক্ত করে চেপে ধরেন! চোখমুখে ফুহ দিয়ে বললেন,,,,

— অবশ্যই বাঁধ্য! আফটার অল ইউ আর মাই পারসোনাল প্রোপার্টি!

চকিত দৃষ্টি দিয়ে তার পানে তাকাই! পূর্ব ভাই বাঁকা হাসছেন! আমি চমকিত কন্ঠে বলি,,,

— কি বললেন?পারসোনাল প্রোপার্টি মানে?

পুনরায় চোখে ফু দিয়ে তিনি বললেন,,,

— ঐটা তো এমনিই বলেছি। যাতে তুই আমার দিকে তাকাস! এন্ড সি, তুই তাকিয়েছিস!

রাগে গা জ্বলে উঠলো প্রায়! বদমাইশ লোক।
পা দিয়ে তার পায়ে গুতো দিতেই তিনি হাত আলগা করে পিছু সরে যান। এই সুযোগে পালাতে নিলেই তা আর হয়না! পিছন থেকে খপ করে হাত ধরে ফেললেন তিনি। হাত বাঁকিয়ে পিঠের কাছে জরো করে আমার কাঁধে থুতনি রাখেন!

কিছুটা শিউরে উঠি! কোনো ছেলে কখনো এভাবে স্পর্শ করেনি আমায়! কোনো ছেলের সংস্পর্শেই আসতাম না কখনো। তবে পূর্ব ভাইয়া এভাবে ধরাতে রাগের থেকে লজ্জাটা যেনো বেশি আক্রমণ করছে!

পূর্ব ভাইয়া নেশাক্ত কন্ঠে বললেন,,,

— কি সমস্যা তোর?ইগ্নোর কেনো করছিস?গত তিন দিন ধরে খেয়াল করেছি তুই আমাকে দেখলেই কেমন ছুটে পালাস!হোয়াই? এভাবে দূরে দূরে যাস কেনো? এই কয়েকদিন কাজের চাপে কিছুই বলতে পারেনি। বাট আজ ছাড়ছিনা! এন্সার মি! আমায় ইগ্নোর করিস কোন সাহসে?

তার কথাগুলো তে কেঁপে কেঁপে উঠলেও তা বাহিরে প্রকাশ করিনা। গত তিনদিন ধরে তাকে এভোয়েড করে চলার চেষ্টা করছি! আর দুমাস পরই অরা আপু দেশে ফিরবে। তার জায়গা আমি কিভাবে নেই?এর থেকে ভালো দূরে দূরে থেকে মায়া কাটিয়ে ফেলা!

পূর্ব ভাইয়া আমার উত্তর না পেয়ে হাতদুটো আরো একটু জোরে চেপে ধরলেন যার ফলস্বরূপ ব্যাথা পাচ্ছি! আমি ব্যাথাতুর কন্ঠে বলি,,,

— পূর্ব ভাইয়া কি করছেন?ব্যাথা পাচ্ছি আমি! ছাড়ুন।

— তার আগে বল ইগ্মোর করিস কোন সাহসে?কেন করছিস?

আমি গলা ঝেড়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বলি,,,,

— ইগ্নোর কই করছি ভাইয়া?আপনি আমার কাজিন! কাজিনের মতোই বিভেব করছি। অভ্র ভাইয়া, সায়ান ভাইয়া,অরণ্য ভাইয়া ওনাদের সাথে যেমন ভাবে কথা বলি আপনার সাথেও সেভাবেই কথা বলি আর সে চোখেই দেখি! এখন এটাকে ইগ্নোর মনে করলে তো আমার কিছু করার নেই!

আমার হাতদুটো আলগা হয়ে আসলো! স্বস্তির শ্বাস ফেলি। তবে মনের নিভৃতে পুড়ছে, ছুরিকাঘাত করার মতো যন্ত্রণা হচ্ছে! যেই যন্ত্রণা মেটাতে পারবে হয়তো কোনো একজন। কিন্তু তাকে পাওয়া অসম্ভব! একটু বেশিই অসম্ভব!

জরোতে নেমে আসা পা দুটোকে টেনে চলে যেতে নিবো তখন ফের পূর্ব ভাই হাত চেপে ধরেন! চোখ বন্ধ করে কাঠ কন্ঠে কিছু বলতে নিবো ঠিক সেই ক্ষনেই পূর্ব ভাইয়া আমায় টান দিয়ে তার দিকে ফেরান। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার ওষ্ঠদ্বয় আমার অধর যুগলের মাঝে বিলুপ্ত করে দেন! ডুবে যেতে থাকেন ধীরে ধীরে আমার অধর যুগলের মাঝে! আকস্মিক কান্ডে আমি স্তব্ধ!

তিনি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আবার নিজের চোখ বন্ধ করে নেয়।

ঝুম এক পশলা বৃষ্টি নামে পৃথিবী পৃষ্ঠে! পূর্ব ভাইয়া ঠিক একইভাবেই আমার অধর যুগলের মাঝে মেতে আছেন। আজ কি হলো জানা নেই। কি হলো এই মূর্হতটায় আমি রাগ করতে পারছি না! তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়ার শক্তি আসছে না। অসার হয়ে আসছে শরীর!

বৃষ্টিতে তার চুলগুলো ভিজে চুপচুপ হয়ে কপালে ছেয়ে আছে। তার চোখ যুগল বন্ধ! আবেশে আমার চোখ দুটো যেনো বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে!

পূর্ব ভাইয়া আমায় ছেড়ে দেন! কপালের সামনের চুলগুলো পিছে সরিয়ে নেয়। পরবর্তীতে ফিচেল কন্ঠে বলে,,,

— আমি তোর কাজিন নই! আর না আমাদের রিলেশন কাজিনের মতো। অরণ্য, সায়ান এর মতো আমাকে ট্রিট করার তোর অধিকার নেই। আশাকরি বুঝেছিস?নাকি অন্য ভাবে বুঝাবো?

হটাৎ লজ্জারা মন গহীনে আন্দোলন শুরু করলো! ব্রেন নির্দেশ দিলো পালিয়ে যা এখান থেকে! পালিয়ে যা!

চট জলদি বড় বড় পা ফেলে গাড়ির কাছে চলে যাই। ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে যাই পূর্ব ভাইয়াকে ফেলে! ব্যাক মিরর দিয়ে দেখলাম তিনি হাসছেন। মোহনীয় সম্মোহন কারী সেই হাসি!

চোখ সরিয়ে নেই। চোখের কার্নিশে পানি এসে জমেছে! কি হতে চলেছে সামনে?

লজ্জা আর ভয় আষ্টেপৃষ্টে জরীয়ে রেখেছে আমায়! সম্ভব হলে এই মূর্হতটাকে আমি দুনিয়ার সময় হিসাব থেকে মুছে দিতাম। রিজন চাইলে বলতাম, ‘এই মোমেন্ট টা সবচেয়ে ভয়ংকর এবং অনুভূতিপূর্ণ এক নতুন অধ্যায় শুরু হওয়ার আগ মূর্হত! একে মুছে ফেললে সবার জন্যই মঙ্গল! ‘

চলবে!

__________________________________

[ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন ]