স্নিগ্ধ প্রেমের সম্মোহন পর্ব-১৩

0
1267

#স্নিগ্ধ_প্রেমের_সম্মোহন
–[পর্ব-১৩]
লেখিকাঃ #সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা

মুখের চিন্তার রেশ ফুটিয়ে গম্ভীর হয়ে বসে আছে ফাজ! সামনেই কিছু ফাইল পড়া যাদের মধ্য থেকে দোলের ছবি অর্ধেক দেখা যাচ্ছে।

ফাজ বর্তমানে যেই কেসটা হ্যান্ডেল করছে তা ছিলো সাত বছর দীর্ঘ সময় ধরে চলছে! তবে ফাজ এই কেসটা হাতে পেয়েছে তিনমাস হতে চললো। রাগে রি রি করছে তার শরীর। এই অফিসার গুলো এতোটা গুরুত্বপূর্ণ একটা কেসকে নিয়ে হেলাফেলা করলো কিভাবে?

ফাজ গোয়েন্দা বিভাগের একজন সিনিয়র অফিসার। ওর পরিচয়, পুরো নাম আজ পর্যন্ত কেও জানেনা! এমনকি তাকে দুচোখে কেও তেমন দেখেনি। সবসময় কালো পোশাকে নিজেকে আবৃত করে রাখে। মুখে কালো রঙের মাস্ক!
ফাজের কন্ঠস্বর ও আজ পর্যন্ত ঠিকভাবে কেও শুনেনি। তেমন একটা কথা বলেনা।ফাজকে সবাই একজন তীক্ষ্ণ মেধা সম্পূর্ণ ব্যাক্তি হিসেবেই চিনে। অন্যান্য দেশ থেকে সিক্রেট ইনফর্মার হিসেবে নিয়োগ দেয়ার জন্য অনেক অফার এসেছে তার কাছে তবে প্রতিবারই তা নাকচ করে দেয় ফাজ! কিন্তু গত বছর কানাডা থেকে বেশ অনুরোধ করা হয় যার ফলস্বরূপ বাংলাদেশ ছেড়ে সেখানে গিয়ে সেটেল হয় সে!

ফাজের আসল পরিচয় একমাত্র হেড অফিসাররা ছাড়া আর কেও জানেনা। কোনো এক প্রেস মিটিং এ তাকে তার পরিচয় গোপন করা বিষয়টি জানতে চাইলে খুব সু- কৌশলে তা এড়িয়ে যায় ফাজ!

ফাজের বর্তমান কেসটা দোলার সাথে রিলিটেড! এবং দোলাকে এই ঘিরেই এই কেসের উৎপত্তি! কেত দোলা কে মেরে ফেলতে চায়। গত কয়েকবছর ধরে সুক্ষ্ম ভাবে ওকে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে একদল লোক তবে প্রতিবারই ব্যার্থ হয় অদৃশ্য কারনে। মেয়ের সেফটির কথা ভেবে দোলার বাবা জোহান আবরার গোয়েন্দা বিভাগকে এই বিষয়টি জানান। অজানা কারণে সে পুলিশকে এ বিষয়ে অবগত করেননি! সাত বছর আগে করা কেসের কোনো ফলই মেলেনি আজ অব্দি!

হটাৎ ফাজের রুমের কাঁচের দরজাটি ভিড়িয়ে হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করে একজন! তাকে দেখে হাতে থাকা দোলার হাস্যজ্বল ছবিটি পাশে রেখে দেয় সে! গম্ভীর কন্ঠে বলল,,,

— ফুয়াদ এনি নিউজ?

ফুয়াদ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,,,

— জি স্যার! অনেক বড় একটা খবর এনেছি।

ফাজ নড়েচড়ে বসে। আগের সুরে বলল,,,

—Say!

ফুয়াদ বড় একটা শ্বাস নিয়ে বলা শুরু করে,,,,

— স্যার দোলা ম্যামকে যে মারতে চান সে বড় কোনো এক জঙ্গি গোষ্ঠীর লিডার। তিনি শুধু দোলা ম্যামকেই না তার পুরো পরিবারকেও শেষ করতে চান। এই লোক বহুত চালাক স্যার, গোপনে নিজের একজন বিশ্বাস্ত লোক দোলা ম্যামের ফ্যামিলির ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছে তাও দোলা ম্যামের জন্মের আগেই। যাকে নজর রাখতে ম্যামের ফ্যামিলিতে ঢুকিয়েছে সে দোলা ম্যামের অনেক কাছের কোনো একজন!

ফাজের কপালের রগগুলো সাড়ি সাড়ি ভাবে দাড়িয়ে গিয়েছে। কে এই লোক? কে মারতে চায় তার স্নিগ্ধপরীকে?

ফাজ হুংকার দিয়ে বলল,,,

— কাকে দোলের ফ্যামিলিতে ঢুকিয়েছে তা জানতে পেরেছো?

— না স্যার। ঐটা জানতে একটু সময় লাগবে। আমরা কাজ করছি!

— কে বেশি ওর ক্লোজ ঐটা জানতে পেরেছো?

— স্যার আপাতত তিনজন ব্যাক্তির নাম জানতে পেরেছি। ম্যামের মেঝ চাচার দুই মেয়ে অরা আর অরিন আর ফায়াজ আবরার পূর্ব!

ফাজ বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে বলল,,,

— সবার ওপর নজর রাখো। ইনফরমেশন কালেক্ট করে দ্যান আমার কাছে আসবে তার আগে না! গট ইট?

ফুয়াদ মাথা নাড়িয়ে ‘হ্যা’ বলে চলে যায়!
ফাজ ধপ করে সোফায় বসে মাথার চুলগুলো চেপে ধরে! কে সেই লোক? পরিবারেই বা কাকে ঢুকিয়েছে? আপনজন এর ধোকা তার স্নিগ্ধপরী সহন করতে পারবে তো?
আপনজন এর ধোঁকা যে একজন মানুষকে ভেঙ্গে চুড়মার করে দেয়।

ভোরের আলো চোখমুখে আছড়ে পড়তেই ঘুম ভেঙে যায়। মাথার যন্ত্রণায় চোখ খোলা বেশ মুশকিল হয়ে পড়েছে। কাল বাসায় এসে আর একবারের জন্য ও দরজা খুলেনি। পুরোটা সময় কেঁদে কেটে চোখ মুখ ফুলিয়েছি! পূর্ব ভাইয়ের থেকে দূরে যেতে চাইলে বিধাতা কেনো তাকে পুনরায় আমার সন্নিকটে পাঠিয়ে দেয়?

ফ্রেশ হয়ে বই নিয়ে পড়তে বসে যাই। তবে মাথার যন্ত্রণার জন্য এক ফোঁটাও পড়তে পারছিনা! গায়ে একটা ওড়না পেঁচিয়ে আলতো করে দরজা খুলে নিচে যেতে থাকি। আশপাশে তাকিয়ে খেয়াল করি পূর্ব ভাই আছেন কিনা! কারণ আপাতত তার মুখোমুখি হওয়ার ইচ্ছে আমার নেই। একদমই নেই!

কিচেনে এসে প্রশান্তিময় শ্বাস ফেলি!
কফি বানানোর জন্য চুলোয় গরম পানি বসিয়ে একটু পিছে সরতেই কারো সাথে ধাক্কা লাগে আমায়। অদ্ভুত শিহরণ সর্বাঙ্গে ছেয়ে যায় মূর্হতেই! মনে কু ডাকছে। কেনো যেনো মনে হচ্ছে আমার যার সাথে ধাক্কা লেগেছে তিনি পূর্ব ভাই!
সামনে ফিরে থাকায় পিছনের ব্যাক্তিকে দেখা অসম্ভব প্রায়!

হুট করে হাতে হেচকা টান অনুভব হয়। একটানে আগন্তুক আমায় সামনে ফিরিয়ে হাত চেপে ধরেন। ভয় পেয়ে বন্ধকরা চোখজোড়া ধীর গতীতে খুলতেই নজরে পড়ে পূর্ব ভাইয়ের রাগান্বিত মুখশ্রী! তাকে দেখে নিজের চুল ছিড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।
ইশ…., কেনো যে রুম থেকে বের হতে গেলাম!

পূর্ব ভাই ঝাঁঝালো কন্ঠে বললেন,,,

— কাল দুপুর থেকে কিছু খাসনি। এখন খালি পেটে কফি খাচ্ছিস? থাপ্পড় চিনিস?অসুখ ডেকে আনিস কেনো?

আমি নিজেকে সামলে বলি,,,

— আমার যা ইচ্ছে তাই করবো তাতে আপনার কি?

— আমার কি?…!

পূর্ব ভাই থেমে গেলেন। অতঃপর ফিচেল কন্ঠে বললেন,,,,

— সে কি জানে?তার অসুস্থতা আমায় দহনে পোড়ায়? তার কষ্ট আমায় জ্বালিয়ে পুড়ে ভস্ম করে দেয়?

চোখ বন্ধ করে নেই চট জলদি! নাহলে চোখের কোনে জমে থাকা পানিগুলো আজ আমার অনুমতি ছাড়াই গড়িয়ে পড়বে।
পূর্ব ভাইয়ার বলা লাইনটা যে আমায় উদ্দেশ্য করে বলেছে তা শতভাগ নিশ্চিত আমি।

মাথা নিচু করে ওপরে যেতে নেবো তখন ফের পূর্ব ভাই আমার হাত চেপে ধরে দেয়ালের সাথে চেপে ধরেন। তার বলিষ্ঠ হাতজোড়া দুপাশে রেখে আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন!
শক্ত গলায় বললেন,,,,

— সাহস তো কম না তোর! আমি কি তোকে চলে যেতে বলেছি ফাজিল?যাচ্ছিস কেনো?

— তো আপনার সাথে দাড়িয়ে দাড়িয়ে কথা বলার আমার টাইম নেই! কয়েকদিন বাদে পরিক্ষা, টাইম ওয়েষ্ট করতে চাইনা।

— ওহ! আমার সাথে কথা বললেই তা টাইম ওয়েষ্ট হয়ে গেলো না? অন্যদের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা ফোনে কথা বলিস তখন পরিক্ষার কথা মাথায় আসেনা?হু?বল বল!

আমি শান্ত দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে। ভেতরেটা নিশপিশ করছে তার কথার রিপ্লাই করার জন্য। তাকে কড়া কয়েকটা কথা শোনাতে মনে কু ডাকছে! কিন্তু এখন কথা বললেই পূর্ব ভাইয়া কথা বাড়িয়ে বেশ কিছুক্ষন সময় পার করিয়ে দিবেন যা আপাতত এই ক্ষনটায় আমি চাচ্ছি না। আমি তার থেকে দূরে থাকতে চাই! অনেক দূরে। যাতে তাকে দেখলে মনের ধুকধুকানি টা বেড়ে না যায়। দূর্বল না হয়ে পড়ি তার প্রতি!

আমাকে চুপ দেখে তিনি ফের বললেন,,,

— কি হলো কথা বলছিস না কেনো?

আমি শান্ত কন্ঠে বলি,,,

— দেখুন ভাইয়া, আপনার কি কোনো কাজ আছে বা কিছু বলার আছে? না থাকলে আমাকে যেতে দিন। আমি আর কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি নই!

পূর্ব ভাইয়া হয়তো বুঝতে পারলেন সে এখন শত চেষ্টা করলেও আমি উত্তর দিবোনা। তাই কিছুটা দূরে সরে গেলেন! ডাইনিং টেবিল থেকে একটা প্লেট হাতে নিয়ে এসে আমার হাত চেপে ধরে চেয়ারে বসিয়ে দেন। কিছু বলবো তাকে তার আগেই মুখে ভাত পুরে দেন। গিলতে না গিলতেই আরেক লোকমা ভাত মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দেন!
আমি হাত দিয়ে তাকে ইশারা করে থামতে বলতেই তিনি চোখ রাঙান! যা দেখে একদম চুপ হয়ে যাই।

এই প্রথমবার তার হাত থেকে খাচ্ছি! লজ্জা আর কিছু অদ্ভুতনাভূতি ঘিরে রেখেছে আমায়!

চলবে,

[ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। ]