স্নিগ্ধ প্রেমের সম্মোহন পর্ব-১৪

0
1226

#স্নিগ্ধ_প্রেমের_সম্মোহন
–[পর্ব-১৪]
লেখিকা: #সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা

জৈষ্ঠ্যমাসের চার তারিখ! প্রকৃতিতে আজ কড়া রৌদ্দুরের আনাগোনা। অতীব গরমে মানুষ থেকে শুরু করে পশু পাখি হাসফাস করছে! তবে এই গরমে সবকিছু অসহ্যকর হলেও একটা জিনিস সবার মন কেড়েছে আর তা হচ্ছে নীল আকাশের মাঝে সাদা ফালি ফালি মেঘ! এ যেনো এক মোহনীয় দৃশ্য!

দেখতে দেখতে বেশ কয়েকদিন কেটে গিয়েছে। আজ এপ্রিলের দুই তারিখ! এইচএসসি পরিক্ষা শুরু আজ থেকে। প্রিপ্রারেশন ভালো হলেও মন গহীনে ভয় ঘুরঘুর করছে। সকাল থেকে আম্মু, আব্বু বাসার সবাই আমায় আর অরিনকে বেশ বুঝিয়েছি চিন্তা করার কারণ নেই কিন্তু আমার ভয়ের রেশটা কাটছেই না। তবে অরিন দিব্যি বয়ফ্রেন্ড এর সাথে প্রেমালাপে ব্যাস্ত! আজ প্রথমবারের মতো আফসোস হচ্ছে একটা বয়ফ্রেন্ড নেই কেনো?

অফিসে জরুরি মিটিং থাকায় আজ আব্বু বা আম্মু কেও আমার সঙ্গে যাবেন না। যাবেন পূর্ব ভাই! কথাটা শ্রবণ করা মাত্রই হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে কান্না করতে ইচ্ছে করছে! কেনো এই লোক কাকতালীয় ভাবে আমার পিছুই পড়ে থাকে? এই কয়েকদিন ওনাকে একদম ইগ্নোর লিষ্টে ফালিয়ে রেখেছি। পূর্ব ভাইয়া প্রায় দুদিন চেষ্টা করেছিলেন কথা বলার জন্য তবে পরিক্ষা কাছিয়ে আসাতে আর ডিস্টার্ব করেননি!

আমি বাহিরে তাকে দেখিয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেললেও ভেতরে ভেতরে দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে গিয়েছি। মন হাজারবার চাইতো তার সাথে কথা বলার জন্য তবে অরা আপুর মুখটা চোখের সামনে ভাসতেই সব অনুভূতি নিমিষেই হারিয়ে যায় অতল গহীনে!

— এভাবে দাড়িয়ে আছিস কেনো? পরিক্ষা দেয়ার ইচ্ছে নেই?

পূর্ব ভাইয়ার কন্ঠ কানে বাড়ি খেতেই শিহরণ বয়ে যায়। পিছু ফিরে তার মুখপানে চেয়ে দেখ বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো!

পূর্ব ভাইয়াকে বেশ বিধ্বস্ত লাগছে। রক্তিম ঠোঁটজোরা জীর্ণ হয়ে আছে। লাল চোখজোড়া সাক্ষী দিচ্ছে তারা কত রাত নির্ঘুম কাটিয়েছে। মলিন চাহনি যেনো আমার ভেতরটা ক্রমশ ক্ষতবিক্ষত করছে!
কান্না পাচ্ছে তার এই অবস্থা দেখে! এমন অবস্থা কেনো তার? এরজন্য কি আমি দায়ী?

পূর্ব ভাইয়া এগিয়ে আসেন ধীর পায়ে। তার একহাত আমার গাল স্পর্শ করান! শান্ত কন্ঠে বললেন,,,

— আমায় ইগ্নোর করে তো খুব সুখেই আছিস হু?জাষ্ট একটা বাট তোর পরিক্ষাটা শেষ হতে দে আমাকে ইগ্নোর করার শাস্তি তোকে চরমভাবে দিবো! ফায়াজ আবরার পূর্ব তোকে এতো সহজে ছাড় দিবে না।

পূর্ব ভাইয়ার স্পর্শে কাতরতা বহন করলেও ভালো লাগা কাজ করছে আজ! তার কন্ঠস্বর শুনে মনে হচ্ছে তাকে ঝাপটে ধরি।

তবে এই সময়টা আমি হাসফাস করে বললাম,,,

— পূর্ব ভাইয়া লেট হচ্ছে! হলে আধাঘন্টা আগে থেকে উপস্থিত থাকা লাগে।

— এড়িয়ে যাচ্ছিস আবার?ফাইন!

গটগট করে হাটা ধরলেন তিনি। ড্রাইভিং সিটে বসে বেশ শব্দ করে গাড়ির দরজা লাগান! বুজলাম, তিনি রেগে গিয়েছেন। তবে আমার আর কিছু করার নেই!

ড্রাইভিং সিটের পাশে বসতেই পূর্ব ভাইয়া বিনাবাক্যে গাড়ি স্টার্ট দেন। পুরো রাস্তায় তিনি একটুও কথা বলেননি। মন বলছিলো ভাইয়া একটু কথা বলুক! তার সু- মধুর কন্ঠস্বর টা বারংবার আমার কানে এসে বাড়ি খেয়ে যাক। তবে পরক্ষণে ব্রেণ ম্যাসেজ দিতো অরা আপুর মুখশ্রী। সঙ্গে সঙ্গে মনের ইচ্ছেটা দুমড়ে মুচড়ে দূরে পাঠিয়ে দিতাম!

খানিক বাদেই এসে পড়ি পরিক্ষার কেন্দ্রে! কলেজ থেকে কিছুটা দূরে সিট পড়েছে। অরিন আগেই চলে এসেছে অরন্য ভাইয়ার সঙ্গে! ওকে বারবার করে বলেছিলাম আমার সাথে যেতে কিন্তু বেয়াদব মেয়ে শুনেনি!

গাড়ির দরজা খুলে নামতে যাবো তার আগে হাতে টান অনুভূত হয়! ঘাড় ঘুরিয়ে পিছে তাকাতেই লক্ষ করি পূর্ব ভাই হাত ধরে আছেন। চোখমুখ দেখে তার কিছুই বুঝতে পারছিনা। হটাৎ তিনি আমার সন্নিকটে আসেন! হতভম্ব হয়ে পিছে সরতে নিবো তবে তা অসম্ভব হয়ে পড়ে।

পূর্ব ভাইয়া কাছে এসে চোখমুখে ফুহ্ দিলেন। ফের চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে কিছু পড়তেই আবারও ফুহ্ দিলেন। এবার বুঝলাম তিনি দোয়া পড়ে ফু দিচ্ছেন!

অতঃপর তিনি নিজের চোখদুটো খুলে আমার কপালে একটা গভীর চুমু একে দেন! এটা আশা করিনি আমি। এতো ইনসাল্ট করার পর তো তার আমার থেকে ১০০ হাত দূরে থাকার কথা।

পূর্ব ভাইয়া গম্ভীর কন্ঠে বললেন,,,

— একদম টেনশন নিবি না! তাহলে পরিক্ষা আরো খারাপ হবে। ঠান্ডা মাথায় কোয়েশ্চেন এর এন্সার করবি! আমি এখানেই আছি। পরিক্ষা শেষ হলে পার্কিং লটে আমাকে পাবি!

মাথা নাড়িয়ে ‘হ্যা ‘ বলে বেড়িয়ে যাই।
সামনে যেতেই অরিনকে খেয়াল হয়। আমাকে দেখে হাত নাড়াতে আমি ওকে না দেখার ভান করে হলে প্রবেশ করি। অরিন দ্রুত দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,,,

— কিরে? এভাবে এতো জোরে হাঁটছিস কেনো?তোকে দাড়াতে বললাম না?

আমি হাটা চলমান রেখে দাঁতে দাঁত চেপে বলি,,,

— দাঁড়াবো না! তোর কি? কতবার বললাম আমার সাথে আয়, তুই অরণ্য ভাইয়ার সাথে গেলি কেনো?

— আমি তোদের সাথে গেলে প্রাইভেসি নষ্ট হতো না তোদের?

কথাটা বলার পর অরিন চট জলদি মুখ চেপে ধরে। সরু চোখে ওর দিকে তাকাতেই ও মিথ্যা হাসির ভান করে বলল,,,

— হে হে! এমনে তাকাস কেন?জলদি চল! টাইম নেই।

— তুই একটু আগে কি বললি?প্রাইভেসি মানে?
(সন্দিহান গলায়)

অরিন আমতা আমতা করে বলল,,,

— পর বলবো। চল এখন, লেট হচ্ছে তো।

মনে হাজারটে প্রশ্ন এসে জরো হলেও আপাতত জিজ্ঞেস করার বা উত্তর পাওয়ার সময়টা হাতে একেবারেই নেই। তাই চুপচাপ হেঁটে পরিক্ষা কক্ষে চলে যাই!

ফাজ ল্যাপটপে ব্যাস্তগতীতে টাইপিং করছে! একগোছা চুল সামনে আছড়ে পড়ে রয়েছে। কপাল দিয়ে আজ ঘাম ছুটছে রুমে এসি থাকা সত্বেও। তখন ফুয়াদ দরজার লক সিস্টেম আনলক করে ভেতরে প্রবেশ করে!

ফুয়াদকে দেখে ফাজ মাথা তুলে তাকায়। ধীর কন্ঠে বলে,,,

— কিছু বলতে চাও ফুয়াদ?

— জ্বী স্যার!

ফাজ ফুয়াদের সিরিয়াস কন্ঠস্বর শুনে ল্যাপটপ পাশে রেখে পানি দিয়ে গলা ভিজিয়ে নেয়। পরিশেষে হাতের ইশারায় ফুয়াদকে নির্দেশ দেয় বসতে!
ফুয়াদ সামনের সিঙ্গেল সোফাটায় বসে পড়ে।
ফাজ পুনরায় বলল,,,,

— কি বলতে চাও? বলো,

— স্যার ম্যামের সাথে যেই তিনজন বেশ ক্লোজ এবং সন্দেহের তালিকায় ছিলো, পূর্ব, অরা, অরিন তাদের ডিটেইলস আর ছবি নিয়ে এসেছি। এছারা তারা প্রতিদিন কোথায় যায়? কি করে? কার সঙ্গে কথা বলে সব ইনফরমেশন নিয়ে এসেছি স্যার। যাদের সাথে তারা কথা বলে তাদের নাম্বারও কালেক্ট করে এনেছি কল সেন্টার থেকে!

— গুড জব ফুয়াদ! তোমার প্রমোশনের ব্যাপারটা ভেবে দেখবো।

ফুয়াদ খুশিতে গদগদ! প্রমোশন হলে বেশ ভালোই হবে তার।তার বউ সোনার হারের জন্য বেশ বায়না ধরেছে।

ফাজ ফের বলল,,,

— ডিটেইলস পেপার দাও!

ফুয়াদ উঠে এসে ফাজকে মোটা একটা ফাইল হাতে দেয়। ফাজ ফাইলটা এক নজর দেখে টেবিলে রেখে দেয়।

ফুয়াদ বলল,,,

— স্যার আমি তাহলে এখন আসি?

— ইয়াহ্ সিয়র! ইউ ক্যান গো।

ফুয়াদ চলে যেতেই ফাজ হাসে! গভীর রহস্যমাখা হাসি। যা দেখলে মিনিটেই কারো মাথা সেই রহস্য উদঘাটন করতে গিয়ে নষ্ট হয়ে যাবে।

পরিক্ষা শেষে বাহিরে আসতেই সর্বপ্রথম আমার চোখজোড়া আঁটকে যায় পূর্ব ভাইয়ার ওপর। তার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে যায় ক্ষনেই! সে তার কালো রঙের গাড়িটায় হেলান দিয়ে একমনে ফোন স্ক্রল করছে! চারিপাশের মেয়েগুলো কেমন ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে তার দিকে! তা দেখে রাগ হয়ে আমার। রাগে শরীর রি রি করছে।

ধুপধাপ পা ফেলে পূর্ব ভাইয়ার সামনে যেতেই তিনি মাথা তুলে তাকান। আলতো করে ঠোঁটের কোনায় হাসির রেখা টেনে ফোন পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে বললেন,,,

— পরিক্ষা কেমন হলো?

আমি রাগ দমন করে বলি,,,

— আলহামদুলিল্লাহ ভালো!

তিনি ফের বললেন,,,,

— কিছু খাবি?খুদা লেগেছে?

আমার খুদা পেলেও তা অপ্রকাশ করে বললাম,,,

— নাহ, খুদা লাগেনি বাসায় চলুন!

কিছুক্ষন সন্দিহান চোখে তাকিয়ে থেকে তিনি আমায় ইশারা করলেন গাড়িতে বসতে। আমি বিনাবাক্যে গাড়িতে বসে পড়ি। পূর্ব ভাইয়া ড্রাইভিং সিটে বসতে নিবেন তখনিই কোথা থেকে একটা মেয়ে দৌড়ে এসে দাঁত কেলিয়ে বলল,,,

— ভাইয়া আপনি ফায়াজ আবরার পূর্ব না?

পূর্ব ভাইয়া মেয়েটার কথায় মাথা নাড়েন!
মেয়েটা পুনরায় হেসে বলল,,,

— ভাইয়া আমি আপনার ফ্যান!আপনার গান না শুনে রাতে একদমই ঘুম আসেনা।

আমি আড়চোখে তাদের দিকে তাকাই।
পূর্ব ভাইয়ার ফেসবুকে নিজস্ব একটা পেজ রয়েছে। তিনি মিউজিশিয়ান বলা চলে। তার পেজে প্রায় সাত লাখ ফলোয়ার!

মেয়েটা আবার বলল,,,,

— ভাইয়া একটা সেলফি তুলতে পারি প্লিজজজ?

পূর্ব ভাইয়া কিছু বলতে গিয়ে থেমে যান। আমার দিকে একবার পরখ করে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দেয়। তিনি বললেন, ‘ সিয়র! ‘

আমার হুট করে কেনো জানি কান্না করতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছে করছে এই ন্যাকা মেয়েটাকে ঠাস ঠাস করে দুটো চড় মারতে। আর পূর্ব ভাইয়াও বা কেমন? রাজি হয়ে গেলেন?তাহলে আমার পিছে আবার কেনো পড়ে থাকেন?কেনো তার আচরণ দ্বারা প্রকাশ করেন তিনি আমায় পছন্দ করেন?হুয়াই?

সেলফি তোলা শেষে মেয়েটা এক পর্যায়ে পূর্ব ভাইয়াকে এক প্রকার জরীয়ে ধরেন। তখন মন অজান্তেই চোখ দিয়ে টুপ করে পানি গড়িয়ে পড়ে! তিনি হেসে মেয়েটাকে বিদায় দিয়ে সিটে বসতেই আমি হুড়মুড়িয়ে তার কলার চেপে ধরে বলি,,,

— কয়টা লাগে তোর?হ্যা?মেয়েদের সাথে এতো ঘেসাঘেসি কিসের?লুইচ্চা লোক!

পূর্ব ভাইয়া ভ্রু কুচকে বললেন, ‘ এটা কেমন বিভেব দোল?’

হুশ ফিরে আমার। নিজের সিটে বসে লজ্জায় মাথা নুইয়ে নেই।

পূর্ব ভাইয়া বেশ খানিকক্ষণ পর বললেন,,,,

— আর ইউ জেলাস?

চমকিত দৃষ্টি দিয়ে তাকাই তার পানে। মাথা নাড়িয়ে না বলে দিই। খেয়াল হয় তিনি হাসছেন। তৃপ্তিকর হাসি!

চলবে,