স্নিগ্ধ প্রেমের সম্মোহন পর্ব-০৪

0
1613

#স্নিগ্ধ_প্রেমের_সম্মোহন
–[পর্ব – ০৪]
লেখিকাঃ #সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা

নিস্তব্ধতায় ছেয়ে থাকা ঢাকা শহর! ধোয়া উড়ন্ত কফি মগ নিয়ে ছাঁদে দাড়িয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য লিলা দেখছি! রাত একটা বেজে গেছে! পড়তে পড়তে চোখ লেগে আসাতে ছাঁদে আসা! বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে গাড়ীর ভিতরের সেই দৃশ্যটি!

ঐ সিনটা মনে করলে কেনো জানি বুকের ভেতর ধুকধুক আওয়াজ টা বেড়ে যায়! আলাদা শিহরণ বয়ে যায় মন গহীনের মাঝে! এই অনুভূতি টাকে কি ট্যাগ দিবো ভেবে পাচ্ছিনা! একদম আলাদা অন্যরকম অনুভূতি এটা!

বাহিরে তাকিয়ে থাকার সময় কারো পায়ের শব্দ কানে ভেসে আসলো। কেও ছাঁদে উঠছে! কিন্তু কে?তাও এতো রাতে? এই সময় তো কারো জেগে থাকার কথা না! পিছু ফিরে তাকাতেই লক্ষ করি পূর্ব ভাইকে! সঙ্গে সঙ্গে চোখদুটো মার্বেল আকার ধারণ করে। এই লোক এতো রাতে ছাদে কি করে?

মনে মনে প্রশ্ন করতেই গম্ভীর কন্ঠে পূর্ব ভাই বললেন,,,

— এতো রাতে ছাঁদে কি?মাথা ফাটিয়ে শান্তি হয়নি?এখন অন্ধকারে পড়ে গিয়ে হাত পা ভাঙ্গতে চাস?

পূর্ব ভাইয়ার কথায় আমি কিছুটা চুপসে গেলাম! তার চক্ষুজোরা কেমন লাল হয়ে আছে! পরনে সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট! এই মধ্যরাতে পূর্ব ভাইয়াকে ফর্মাল লুকে দেখে একটু সন্দেহ জাগলো মনের নিভৃতে! তার মাঝেই তিনি আবার প্রশ্ন করেন,,,

— কি হলো কথা বলছিস না কেনো?এতো রাতে ছাদে কি?

আমি আমতা আমতা করে বলি,,,,

— পড়তে পড়তে ঘুম পাচ্ছিলো। ঘুম কাটাতেই ছাদে আসা! আমি চলে যাবো একটু পর পূর্ব ভাই!

শব্দগুচ্ছো গুলো পেট থেকে বের করে দিয়ে ফুস করে শ্বাস ছাড়ি! সামনে তাকাতেই পূর্ব ভাইয়ার নীল মনি বিশিষ্ট চোখযুগলে আমার দৃষ্টি আবদ্ধ হয়! তিনি আমারই দিকে তাকিয়ে আছেন। কেমন ঘোরলাগা দৃষ্টি নিয়ে! তার নীল চক্ষুজোরায় বেশিক্ষণ তাকাতে পারলাম না। কেমন সম্মোহীত দৃষ্টি! চোখ দিয়ে তিনি যেনো আমায় কত কথা বলছেন, বলতে চাইছেন!

পূর্ব ভাইয়া পিছন থেকে সরে গিয়ে সামনে আগান! রেলিঙ এ ভর দিয়ে একহাতে ইশারা করে আমায় সামনে ডাকেন!

আমি গুটিগুটি পায়ে সামনে এগোতেই তিনি আমার হাত থেকে কফি মগটা খপ করে কেড়ে নেন! হতভম্ব হয়ে যাই! কফি মগটা হাতে নিতেই তিনি তার রক্তিম ঠোঁটযুগল তাতে স্পর্শ করে চুমুক দেন!

আমি অবাক চাহনি দিয়ে তাকিয়ে আছি তার মুখপানে! পরক্ষণে বলি,,,

— ভাইয়া কফি খাওয়ার হলে আমাকে বলতেন। আমার এঁটো করাটা খাচ্ছেন কেনো?ঐটা রেখে দিন আমি নতুন করে বানিয়ে আনছি!

আমার কথা তিনি শুনলেন কিনা জানা নেই! বাহিরে দৃষ্টি রেখে দ্বিতীয়বার কফি মগে চুমুক দেন।পূর্ব ভাইয়ার এমন রূপ দেখে জ্ঞান হারাতে মনে চাইছে! উনি কখনোই এঁটো করা খাবার বা অন্যের ঝুটা খাবার খান না! তবে এসব কি?
কাঁদো কাঁদো চাহনি দিয়ে চেয়ে আছি। কিছুই বোধগম্য নয় আমার!

হটাৎ তিনি বাহির থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আমার দিকে তাকান! ভ্রু কুচকে বললেন,,,

— এভাবে কাঁপছিস কেনো?শীত লাগছে নাকি?

আমি হ্যা বলে দেই! কারণ সত্যটা বলা অসম্ভব! কিভাবে বলবো পূর্ব ভাইয়ার এই রূপ আমার সহ্য হচ্ছেনা! তার এই বদলে যাওয়াটা তাও আমার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র! সেটা যে প্রতি ক্ষনে আমায় ভাবায়।উত্তর পাওয়ার আশায় দিশেহারা হয়ে যায় মন।

পূর্ব ভাইয়া কফি মগটা ছাঁদে পাতানো টি – টেবিল এ রেখে দেন! আমার কাছে এসে তিনি নিজের গায়ের শার্ট খুলতে শুরু করেন! তা দেখে ভয় ঝেকে ধরে! ছাঁদ থেকে যাওয়র জন্য ইউ টার্ন মারবো তার আগেই তিনি তার সাদা শার্ট আমার গায়ে জরীয়ে দেন! তার পরনে একটা ধূসর রঙের টি শার্ট! শার্টের নিচেই পড়াছিলো!

তিনি বললেন,,,

— ভালোভাবে শার্টটা জরীয়ে নে। শীত কম লাগে!

আমি রোবটের মতো মাথা দুলিয়ে হ্যা বলি! তার সাদা শার্টটা ভালোমতো গায়ে জরীয়ে নেই! শার্ট থেকে একটা মনোমুগ্ধকর স্মেল আসছে! নাক টেনে ঘ্রাণ নিতেই কেমন নেশা লেগে যায়! অতঃপর নিজের ভাবনায় থু ছিটিয়ে নরমাল হয়ে নেই! ছিহঃ চিন্তা ভাবনার কি শ্রি আমার! কাজিনকে নিয়ে উল্টো পাল্টা চিন্তা আসছে..! যদিও পূর্ব ভাইয়া আমার আপন কাজিন নয়! বড় চাচা যাকে আমি সম্মোধন করি তিনি হচ্ছেন বাবার বেষ্টফ্রেন্ড এর থেকেও বেশি একজন! মেঝ চাচু, বড় চাচা আর আমার বাবা তারা তিনজনই খুব ক্লোজ বন্ধু ছিলেন! তাদের সম্পর্ক যেনো মৃত্যু পর্যন্ত অটল থাকে তাই তারা এই বাড়িটা কিনেন! তারা তিনজন একই সাথে থাকেন সাথে আমরাও!

আব্বুর বন্ধুরা ভাই এর মতো তাই আমরাও তাদেরকে চাচা বলে সম্মোধন করি! আমাদের ফ্যামিলিকে দেখে কেও বলতেই পারবেনা আমাদের মাঝে রক্তের সম্পর্ক নেই! চাচারা আলাদা রক্তের! মাঝেমধ্যে নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হয় এই ফ্যামিলির সদস্য হওয়াতে! কিন্তু পূর্ব ভাইয়ার ম্যাটার আলাদা! তিনি একজন সাংঘাতিক লোক! মারাত্মক সাংঘাতিক!

আব্বুর থেকে পূর্ব ভাইয়ের বাবা রায়ান আংকেল সাত বছরের বড় তাই তাকে বড় চাচা বলা! আর মেঝ চাচু পাঁচ বছরের বড় তাই তাকে মেঝ চাচু সম্মোধন করা হয়! বয়সের পার্থক্য থাকলেও তাদের মাঝের সম্পর্ক যেনো খাটি হিরের মতো!

মনে যখন এসব ভাবায় ব্যাস্ত আমি তখন খেয়াল হয় পূর্ব ভাই আমায় ডাকছেন! ভ্রু কুচকে বলল,,,,

— কিরে? কি ভাবিস? এভাবে অন্যমনষ্ক হয়ে আছিস কেনো?

— কিছুনা পূর্ব ভাইয়া!

পূর্ব ভাই আমার উত্তর পেয়ে টি টেবিল এর কাছে গেলেন! এক চুমুকে কফি শেষ করে এসে ফের রেলিঙ এর কাছে গিয়ে দাড়ান! হেলান দিয়ে বললেন,,,

— তোর এক্সাম এপ্রিলে না? বিডির এক্সাম সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই! কখন হয় বোর্ড এক্সাম?

— এপ্রিলে ভাইয়া!

—- এখন তো জানুয়ারি চলে! দুমাস আছে,… আচ্ছা লিষ্টেন কাল থেকে তুই আমার কাছে পড়বি! বাহিরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই!

পূর্ব ভাইয়ার কথা শুনে হার্টটা বোধহয় দ্রুত বিট হচ্ছে! তিনি আমায় পড়াবেন?ইম্পসিবল! তার কাছে পড়া যাবেনা! একদমই না!
আমি অস্ফুটস্বরে বলি,,,

— নাআআআ! আমি আপনার কাছে পড়বোনা!

ভাইয়া একটা ভ্রু উঁচু করে জিজ্ঞেস করলেন,,’ কেনো?’

আমি আমতা আমতা করে জবাব দেই,,,

— আমাকে পড়িয়ে নিজের টাইম কেনো ওয়েস্ট করবেন পূর্ব ভাই? আপনার এতো বড় কোম্পানি কে সামলাবে তাহলে? দরকার নেই আমায় পড়ানোর।

—আমার কোম্পানি নিয়ে তোর না ভাবলেও চলবে! কোম্পানির কাজ কানাডায় বিডিতে না! এখানে আমি তিনমাসের হলিডেতে এসেছি। সব কিছু গুছিয়েই এসেছি। কাল সন্ধ্যায় আমার স্টাডি রুমে আসবি!

আমি ফট করে বলে দেই,,,

— না….! কোনোদিনও না, আপনার মতো খারুশ, বদমেজাজি, ফাজিল, বদ লোকের কাছে আমি পড়বোনা!

বলার সাথে সাথেই মুখ চেপে ধরি! আল্লাহ কি বলে ফেললাম? পূর্ব ভাইকে দেখলাম তিনি রক্তচক্ষু দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছেন। শুকনো ঢক গিলে যেই পিছু ফিরে দৌড় দিবো তার আগেই কোথা থেকে তিনি এসে হাত ধরে হেঁচকা টান মেরে দেয়ালের সাথে চেপে ধরেন! ভয়ে চোখমুখ খিচে বন্ধ করে নেই! অনবরত কাঁপছি আমি! পূর্ব ভাইয়া নিশ্চিত থাপ্পড় মারবেন এখন!

তার উত্তপ্ত নিঃশ্বাস চোখমুখে আছড়ে পড়তেই শিউড়ে উঠি! তিনি বোধহয় আমার খুব সন্নিকটে! চোখ খুলতেই নজরে পড়ে তার লাল হয়ে থাকা চোখদুটো। একদম আমার মুখের কাছে তার মাথা এনে নিয়েছেন। দাঁতে দাঁত চেপে গম্ভীর হয়ে বললেন,,,

— একটু আগে ঐসব কি বললি? সাহস দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে তাইনা?

আমি না জানার ভান ধরে বলি,,,

— কই কি ব,,ললা ম পূর্ব ভা,ই? আপনি হয়,তো ভুল শুনেছেন কিছু!

— একদম মিথ্যা বলবিনা আমার কাছে দোল! থাপ্পড় একটাও মাটিতে পড়বেনা তাহলে,

বড় করে একটা শ্বাস টেনে নেই! দুহাত দিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে তাকে ধাক্কা দেয়ার প্রানপণ চেষ্টা করাতে ব্যার্থ হই! অসহায় চাহনি দিয়ে তাকাই তার দিকে! পূর্ব ভাই হাসছেন! বাঁকা হাসি যাকে বলে। সেই হাসি দেখেই কলিজার পানি মনেহয় শুকিয়ে গেলো!

এবার সাহস নিয়ে তার দিকে মুখ আগাই! এতে প্রথমবার তিনি আমার কর্মে ভড়কে যান! আমি সুযোগ বুঝে তার দুহাত ঝাড়ি মেরে এক দৌড়ে ছাঁদ থেকে নেমে যাই। পিছন থেকে পূর্ব ভাইয়ার ঝাঁঝালো কন্ঠস্বর শুনে ভয় পেলেও থেমে যাইনি!

______________________________

রুমে আসে প্রশান্তির শ্বাস ফেলে দ্রুত দরজা লাগিয়ে দেই! বলা তো যায়না কখন তড়িৎ বেগে পূর্ব ভাইয়া এসে পড়েন রুমে!

বেডের দিকে নজর যেতে ভ্রু কুচকে আসে! বেডে কিছু প্যাকেট রাখা! খুলতেই প্রথমে সামনে পড়ে একটা চিরকুট, যাতে লিখা…..

স্নিগ্ধপরী,
ভুলেও অন্য কোনো ছেলের সাথে মেশার চেষ্টা করবে না। কথা তো দূরে থাক! নয়তো আমার থেকে খারাপ কেও হবেনা! যেই ছেলের সাথে মিশবে তাকে আমি টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলবো! সর্বক্ষণ আমার নজর কিন্তু তোমাতেই থাকে।

চিরকুট টা পড়ে কি রিয়্যাক্ট করা উচিত আমার? কে এই লোক?হায় মাবুদ…! এ আবার কোন নতুন বিপদ?পূর্ব ভাইয়া কি যথেষ্ট ছিলেন না?

চলবে,

____________________________