স্নিগ্ধ প্রেমের সম্মোহন পর্ব-৪৯

0
1082

#স্নিগ্ধ_প্রেমের_সম্মোহন
#সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা
|পর্ব-৪৯|

অক্টোবর এর চার তারিখ আজ। কানাডায় এখন শরৎকাল এর পদচারণা। এই সময়ে কানাডাজুরে দেখা যায় বিভিন্ন জাতের ম্যাপেলগাছ।এই সময়ে ম্যাপেলগাছের পাতাগুলো বিভিন্ন রং ধারণ করে।আকাশে উড়ে সাদা মেঘের ভেলা। গাংচিল এর কিচিরমিচিরে মন দুলতে থাকে!

বিরাট এক আলসেমি ভাব নিয়ে কফিতে সিপ দিয়ে চারিপাশে তাকাই। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ক্যান্টিনের চারিদিকে তাকিয়ে দৃষ্টি দেই সামনে! সাথে সাথে বিরক্তি এসে ভর করে।
সামনে বসে নীরব তার নিউ গার্লফ্রেন্ড আদ্রিনার সাথে প্রেমালাপে ব্যাস্ত। আদ্রাফ হাই তোলার ভঙ্গি করে বইয়ের মাঝে মুখ ডুবিয়ে রেখেছে। গলা ঝেড়ে আদ্রাফকে উদ্দেশ্য করে বলি,

-‘ ঘুম আসছে তো ঘুমা! এমন করলে পড়া মনে থাকবে। এমন ভাব দেখাস যেনো বিদ্যাসাগর ট্যাগ টা তুই এবার ছিনিয়েই নিবি, হুহ্! ‘

মুখ বাকিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে। তার আগে দৃশ্যমান হয় আদ্রাফের অসন্তুষ্ট চেহারা। কানে ভেসে আসে সিরিয়াস কন্ঠস্বর! আদ্রাফ বলল,

-‘ দেখ দোল তুই পড়ার হলে পড়, নয়তো আমাকে ডিস্টার্ব করা বন্ধ কর। ‘

ঝাঝালো কন্ঠে আদ্রাফ কে কিছু বলতে নিবো তৎক্ষনাৎ ফোনো টুং করে ম্যাসেজ আসার পর শব্দ হয়! আড়চোখে টেবিলে পড়ে থাকা ফোনের দিকে তাকাতেই খেয়াল হয় ‘পূর্ব ‘ নামটি। হাতে ফোন নিয়ে ম্যাসেজ চেক করে দেখি তিনি বলছেন,

-‘ জলদি নিচে আয়! ওয়েট করছি’

ফোন ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখে দাড়াতে দাড়াতে আদ্রাফকে উদ্দেশ্য করে বলি,

-‘ কাল মেডিকেলে এসে তোর খবর নিবো, দেখিস! অসভ্য! ‘

আদ্রাফ টিটকারি মেরে বলল,

-‘ যা যা, আসিস! ভয় পাই তোকে?আসছে…’

লিফট দিয়ে নেমে দ্রুত নিচে চলে যাই। কানডায় এসেছি আজ দুইদিন। এসেই মেডিকেলের পড়ার চাপে নাজেহাল অবস্থা! আজ আফসোস হচ্ছে, কেনো মেডিকেলে পড়লাম?লাষ্ট পর্যন্ত টিকবো তো?এই ভয়টা যখনই আমার মাথায় চেপে বসে পূর্ব খুব সুন্দর মতো আমায় বুঝিয়ে সাহস জোগায়। একটা জিনিস মাঝেমধ্যে অবিশ্বাস্যকর লাগে আমার কাছে পূর্ব কি আসলেই আমার? একান্ত ব্যাক্তিগত সম্পদ?

এতোটা গুণসম্পন্ন হ্যাজবেন্ড পাওয়ার সৌভাগ্য আদও আমি নিয়ে জন্মেছি। প্রতি ধাপে সঠিক দায়িত্ব পালন করে তিনি! কেয়ারিং হ্যাজবেন্ড, পার্ফেক্ট একজন প্রেমিক পুরুষ, টিচার, অতঃপর আমায় বোঝার ক্ষমতা!এই জ্ঞানটা সম্পূর্ণ আছে তার। আমি নিশ্চিত তিনি আমায় আমার থেকে কয়েক ধাপ বেশি বুঝতে এবং অনুভব করতে পারেন।

ভাবনার মাঝে গেট পেরিয়ে বের হয়ে আসি! পূর্ব তার কালো গাড়িটার সামনে দাড়িয়ে। এখানে এসেও সে কালো গাড়িই কিনেছেন।

মুখে মাস্ক, মাথায় ক্যাপ, চোখে সানগ্লাস! প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে গাড়ির দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। হটাৎ হাসি পেলো তার এই লুক দেখে। যদিও এটার সম্পূর্ণ ক্রেডিট আমার। কেননা তিনি প্রায় সময়ই ফিটফাট হয়ে চলেন। এতে করে এখানে আসলে বেশির ভাগ মেয়েরা তার দিকে গভীর দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে থাকেন যা একজন স্ত্রীর তরফ থেকে অসহ্যকর! তাই তাকে বলা এভাবে চলতে। অদ্ভুত ব্যাপার তিনি টু শব্দ ও করেননি বা জানতে চাননি এভাবে কেনো চলাফেরা করবো?

লম্বা লম্বা পা ফেলে পূর্বের কাছে গিয়ে দাঁড়াই। নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করি,

-‘ কখন এসেছেন?’

পূর্ব নিজের হাতে থাকা ব্লাক ওয়াচ টার দিকে তাকায়। অতঃপর মাথা তুলে তিনি বললেন,

-‘ ১৭ মিনিট, ‘

-‘ তাহলে মাত্র ম্যাসেজ দিলেন কেনো? আসার সাথে সাথেই তো দিলে হতো। ‘
তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে পূর্বকে জিজ্ঞেস করি।

-‘ ফোন এসেছিলো। কথা বলতে বলতেই ১৪ মিনিট পার। ‘

-‘অহ!’

ছোট্ট করে জবাব দিয়ে আমি গাড়িতে উঠে বসি। পূর্ব ঘুরে এসে বসে পড়লেন ড্রাইভিং সিটে। আমি নিজের সিটবেল্ট বেঁধে সোজা হয়ে বসতেই টের পাই নিজের কারো উষ্ণ ছোঁয়া অনুভব করলাম যেনো। চট জলদি ডানে তাকিয়ে দেখি পূর্ব আমার অতি সন্নিকটে। সরে যেতে নিলেই তিনি তার দুহাত আমার কোমড়ে রেখে গালে ছোট ছোট চুমু একে দিতে থাকেন। আমি চোখমুখ কুঁচকে বলি,

-‘ পূর্ব কি করছেন? ছাড়ুন! ‘

পূর্ব তার ঠোঁট আমার গালে বিদ্যমান রেখে ফিসফিস করে বললেন,

-‘হুশশ! ডোন্ট ডিস্টার্ব মি। ‘

বলতে বলতে ব্যাস্ত হয়ে গেলেন তিনি আমার গালে নিজের অধরের ছোঁয়া দিতে। দু হাত দিয়ে তার বুকে ধাক্কা দিলে তিনি আমার হাতদুটো পিছু মুরে কোমড়ে চেপে ধরেন। পাঁচ মিনিট অতিবাহিত হয়ে গেলে কপালে শব্দ করে একটা চুমু খেয়ে পূর্ব খানিকটা দূরে সরে বসলেন! তবে অতোটা দূরে নয়। তার ভারী নিঃশ্বাস এখনো আমার গালে আছড়ে পড়ছে। চোখমুখ কুঁচকে তাকিয়ে আছি তার দিকে।

পূর্ব অতি নিম্ন কন্ঠে নেশালো কন্ঠে বললেন,

-‘ কতোটা লং টাইম আমায় তোর থেকে দূরে থাকতে হয়। এই পুরোটা সময় পাগলের মতো ছটফট করি কখন তোর স্নিগ্ধময় চেহারা একবার দেখবো। গোলাপের পাপড়ির মতো ঠোঁটে উষ্ণ ছোঁয়া দিবো। কাজের মাঝে সর্বদা তোর কথা, তোর হাসি, তোর ভ্রু বাকিয়ে তাকানো ফুটে উঠে! ঠিকমতো কাজও করতে পারিনা আমি তোর জন্য! এতোটা আসক্ত কিভাবে হলাম তোর প্রতি বলতো?এতোটা স্নিগ্ধময় সৌন্দর্যের অধিকারী কে হতে বলেছে তোকে?কে বলেছে এতোটা মায়াবীনি হতে? কে বলেছে নিজের স্নিগ্ধ প্রেমের সম্মোহনে আমায় সম্মোহীত করতে? ‘

পূর্বের বলা প্রতেকটা কথা যেমন বক্ষপিঞ্জরে তীরের মতো বিঁধেছে, তেমনি থতমত হয়ে গিয়েছি আমি। ঘোর কাটিয়ে আমি ঠোঁট বাকিয়ে বললাম,

-‘ এক কাজ করুন, এই বিজন্যাস ছাড়ুন আর আমার সাথে মেডিকেলে ভর্তি হয়ে যান। সারাদিন ক্লাসমেট হয়ে পাশে থাকবেন। একদম সকাল হতে বিকাল পর্যন্ত! আর বাকি টাইম তো আঠার মতো লেগেই থাকেন সো?ট্রাই করতে পারেন কিন্তু! ‘

বিরক্তি কন্ঠে কথাগুলো বলে তার দিকে তাকাই। পূর্ব ভ্রু কুচকে কিছু ভাবছেন। এক সময় তিনি চিন্তিত কন্ঠে বললেন,

-‘ ঠিক বলেছিস, ট্রাই করা যায়?হু? ভাইয়াকে বলছি তাহলে আমি আর কোম্পানি হ্যান্ডেল করবো না। আবারও পড়ালেখা করবো দ্যন বউয়ের সাথে ডাক্তার হবো। ‘

পূর্বের বলা কথায় কিছুক্ষন তার দিকে গোল গোল চোখে তাকিয়ে থেকে ফিক করে হেঁসে দিই! হাস্যরত অবস্থাতেই বলি,

-‘ পাগল একটা! ‘
_______________ (সাতমাস পর)

-‘ এই তিন পুচকুর নাম হবে ইবা, লিয়া, তিরা! এটাই ফাইনাল। এটা ওদের নিকনেম বাকি যা নাম দেয়ার তা তোমরা দিয়ে নিও। ‘

কথাটি বলে আমি কোলে তুলে নিলাম ইবাকে। চোখ পিটপিট করে সদ্য জন্ম নেয়া পিচ্চিটা তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আলত করে পিচ্চির মাথায় চুমু খাই! তখন অরিন বেডে থেকে উঠে বসে বলল,

-‘ নামগুলো জোস! একদম আমার মনমতো হইছে। অভ্র? আমাদের বাবুর নাম এটাই ফাইনাল। ‘

অরিনের কথায় অভ্র ভাইয়া চোখ পাকিয়ে বললেন,

-‘ ওকে বাট তুমি লাফালাফি কম করো। পেটের সেলাই এর জায়গায় ব্যাথা পাবে। ‘

অরিন চোখমুখ কুঁচকে নেয়। ধীরে ধীরে অভ্র ভাইয়ার সহায়তায় বেডে শুয়ে পড়ে ফের। মেঝ চাচি এগিয়ে এসে লিয়াকে কোলে নিয়ে বললেন,

-‘ কই দেখি। আমার লিয়া দাদু কে দেখি ‘

আমি ইবাকে কোলে নিয়ে হসপিটাল কেবিনের কর্নারে দাঁড়িয়ে থাকা পূর্বের দিকে তাকাই। তিনি এক দৃষ্টিতে ইবার দিকে তাকিয়ে আছেন। ধীর পায়ে এগিয়ে যাই তার দিকে। ইবা, লিয়া, তিরা এই তিনজন সদ্য জন্ম নেয়া বাচ্চাগুলো অরিনের। দীর্ঘ অপেক্ষার পর আজ তারা তিনজন পৃথিবীর আলো দেখেছে।

পূর্বের কাছে গিয়ে আমি ইবাকে দেখিয়ে বলি,

-‘ কোলে নিবেন ওকে?’

পূর্ব খানিকটা ভীতিগ্রস্ত হয়ে বললেন,

-‘ উঁহু! ব্যাথা পায় যদি।’

পূর্বের কথায় খিলখিল করে হেঁসে দিই আমি। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে আমার হাসি দেখে ইবার ঠোঁটের কোনা একটু হয়তো প্রসারিত হলো। কেনো যেনো আমার দেখে মনে হলো ও হাসছে। তা দেখে আমি খুশিতে গদগদ! পূর্বকে উদ্দেশ্য করে বলি,

-‘ এই দেখুন, ইবা হাসছে! ‘

ভ্রু দুটি একসাথে করে নেয় পূর্ব। সন্দিহান কন্ঠে বললেন,

-‘ সদ্য জন্ম নেয়া বেবি স্মাইল করতে জানে?’

আমি ভাবান্তর হয়ে বলি,

-‘ জানিনা ঠিক। তবে ঐটা পরে দেখা যাবে আপনি আগে ওকে কোলে নিবেন এক্ষুনি!’

আমার জোরাজুরিতে পূর্ব ইবাকে কোলে নিতে বাধ্য হয়। কোলে নিয়ে কেমন ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে! তা দেখে দম ফাটানো হাসি পাচ্ছে আমার। তবে এই টাইমে হাসাটা বেমানান!

দীর্ঘ একটা সময় হসপিটালে কাটিয়ে আম্মু, মামনি আমিসহ ভাইয়া, পূর্ব, বড় চাচা, মেঝ চাচুকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছেন। অরিনকে পরশু রিলাইজ দেয়া হবে তাই বাকিরা সেই দিন অব্দি হসপিটালে থাকবেন। অরিন এবং বাবুসহ সবাই একসাথেই বাসায় ফিরবেন!

ফ্রেশ হয়ে সোফায় বসে আছি! মাথায় এক ভূত ঢুকেছে আজ। অরিনের বাচ্চাদের দেখার পর কেনো যেনো নিজের মা হওয়া অদম্য ইচ্ছে জেগেছে। কিন্তু মনে ভয়ে ঝেকে বসেছে। কারণটা পূর্ব। তিনি চাননা এটা! কারণ হিসেবে তার মতে মা হলেই মারা যায়, প্রচুর কষ্ট ভোগ করতে হয় আর তিনি সামনপ থেকে আমাকে কষ্ট পেতে দেখতে পারবে না, সহ্য করা তার পক্ষে মুশকিল হবে তাই এ বিষয়ে তিনি ঘোর অমত পোষণ করেছেন।এ কয়েক মাসে তাকে বোঝানোর শত চেষ্টা করার পরও প্রতিবার ব্যার্থ হতে হয়েছে। কিন্তু অরিন বেবি হওয়ার পরও সুস্থ, এটা একটা চান্স আমার কাছে! তাই আশা নিয়ে রুমে চুপটি করে বসে আছি।

ওয়াশরুম এর দরজা খুলতেই নড়েচড়ে বসে। পূর্ব টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

-‘ দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? এখন একটু ঘুমা। সারাদিন কম খাটুনি তো যায়নি। ‘

আমি হাত মোচড়াতে মোচড়াতে বলি,

-‘ আমি কিছু বলতে চাই!’

-‘ বল?’

লম্বা শ্বাস টেনে করুন কন্ঠে বলি,

-‘ পূর্ব আমি মা হতে চাই প্লিজ! দেখুন, অরিনের বেবি হওয়ার পরও ও কতোটা সুস্থ আছে। আমিও সুস্থ থাকবো ইনশাআল্লাহ। ‘

পূর্বের মুখ গম্ভীরতায় ছেয়ে যায়। সে গম্ভীর কন্ঠে বলল,

-‘ একদম না! আগেই না করেছিনা আমি?দরকার পড়লে বাচ্চা এডপ্ট করবো দোল, ‘

চলবে…..