স্নিগ্ধ প্রেমের সম্মোহন পর্ব-১০

0
1275

#স্নিগ্ধ_প্রেমের_সম্মোহন
–[পর্ব-১০]
লেখিকাঃ #সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা

{অতীত-প্রথম দেখা}❤️

আবরার ম্যানশন আজ খুশিতে গমগম! চারিদিকে যেনো আজ খুশির আলো চিকচিক করছে। এই খুশির কারণটা হচ্ছে আজ বড় চাচার ছোট ছেলে প্রথম বারের মতো বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখতে যাচ্ছেন। খুশির যেনো অন্ত নেই কারো!

বড় চাচার ছোট ছেলে এতদিন কানাডাতে ছিলেন। বাংলাদেশে আসেননি কারণ তার মতে বাংলাদেশে আসলে সে তার ক্যারিয়ার উন্নতি করতে পারবে না। এই কথাটা শুনে রাগে আমার গা জ্বলে উঠেছিলো। আমার দেশে জন্মে আমার দেশকেই অপমান?
যদিও তিনি বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেননি। কানাডাতেই তার জন্ম!

আজ দেশে ফিরছেন চাচাদের অনুরোধে তাও ক্ষনিকের জন্য ! তবে তাতে আমার কি? আমি তো মনে প্রাণে চাই এই লোক দেশে না আসুক।

সকাল হতেই আবরার ফ্যামিলির সবাই উঠে পড়ে লেগেছে আবরার ম্যানশন কে সাজাতে। রঙ বেরঙের ফেইরি লাইট দিয়ে গার্ডেন ভরে ফেলেছে। যা আমার কাছে বিরক্তিকর! মেঝ চাচি প্রায় চারবার এর মতোন সার্ভেন্ট দিয়ে পুরো বাড়ি পরিস্কার করে মুছিয়েছেন। পূর্ব ভাইয়ার নাকি অপরিচ্ছন্ন কিছু পছন্দ না! তিনি সবকিছু নিট এন্ড ক্লিন চান। হুহ্ আজাইরা!

বড় চাচার ছোট ছেলের নাম পূর্ব! পুরো নাম ফায়াজ আবরার পূর্ব! আমাদের বাসার সব ছেলেদেরই নামের শেষে বা মাঝখানে ‘আবরার’ শব্দটা থাকে! এটা আমাদের বংশ পরিচয়।

বাবা আর চাচুরা বেষ্টফ্রেন্ড হলেও তাদের বাবারাও ছিলেন বেষ্টফ্রেন্ড! মানে আমার দাদা! তাই তারা একসাথে ঠিক করেছে আমাদের বংশের প্রতিক হবে ‘আবরার’! সেই থেকেই যেই ছেলে এই পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তাদের আবরার উপাধি টা দেয়া হয়।

সবাই আমাদের বাড়িটাকে ‘আবরার ম্যানশন’ হিসেবেই চিনেন। পুরো এলাকায় আমাদের বাড়িটা রাজপ্রাসাদ এর মতো। সবই দাদুদের তৈরি করা। ছুটির দিনে প্রায়সই এই বাড়ি দেখতে আসে অনেকে! আগে দেখার অনুমতি দেয়া হলেও আমরা মেয়েরা যখন বড় হয়েছি তখন থেকে আর বাড়িটা দেখার অনুমতি দেয়া হয়না। যার ফলস্বরূপ সবাই বাহির থেকে এক নজর দেখে চলে যান!

সকাল থেকে বেডে মটকা মেরে শুয়ে আছি। দু একবার বেলকনিতে গিয়ে নিচে উঁকি দিয়েছিলাম কিন্তু একই দৃশ্য নজরে পড়েছে! যার কারণে ধুপধাপ এসে বেডে ঠাস করে শুয়ে পড়েছি! পূর্ব ভাইয়াকে এখন আমার সতীন সতীন লাগছে! ওপ্স ‘সতান’ হবে! মেল ভার্সন!

________________________________

আলসেমি আর রাগটা ঝেড়ে নিচে আসি! ফ্রেশ হয়ে টিশার্ট আর প্লাজু বদলে নরমাল কুর্তি আর জিন্স পড়ে নেমেছি!

নিচে নামতেই পুরো বাড়িটা কে দেখলাম একদম পরিস্কার! যদিও সবসময় এমনই থাকে তবে আজকে আলাদা কিছু আছে। যার কারণে বাড়িটা চকচক করছে।

ড্রইং রুমে দৃষ্টি দিয়ে দেখি অরিন সোফায় পা তুলে বসে নুডলস খাচ্ছে আর টিভি দেখছে! কিছু না ভেবে সেদিকে পা বাড়াই।
অরিনের পাশে ধুপ করে বসে ওর হাতে একটা চিমটি দেই। মেয়ে একদম টিভিতে ডুবে আছে!

আমার চিমটিতে অরিন ব্যাথায় নাকমুখ কুঁচকে কটমট দৃষ্টি দেয়। তারপর ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে,,,

— কি সমস্যা? চিমটি দিলি কেন?

— এমনি!তোর হুশ ফিরাতে। এভাবে তাকিয়ে আছিস যেনো শিনচেন তোর সামনে বসা!

অরিন ভ্রু বাকিয়ে আবার টিভিতে মনোযোগ দেয়। মাঝেমধ্যে এক চামচ নুডলস মুখে পুরে দিচ্ছে। আমি গলা ঝেড়ে জিজ্ঞেস করি,,,

— অরি শোন!

অরিন টিভির দিকে তাকিয়েই বলল,,,

— হু বল! শুনতাছি,

— পূর্ব ভাইয়া কখন আসবে?

আমার কথা শুনে অরিন কেশে দেয়। আমার দিকে অবিশ্বাস্য নজরে তাকিয়ে বলল,,,

— সিরিয়াসলি?তুই পূর্ব ভাইয়ের কথা আস্ক করতেছোস?বাপড়ে…! যেই তুই পূর্ব ভাইয়ার কথা শুনলেই নাক মুখ শিটকে নিস! আবার তার কথা জিজ্ঞেস করোস?দাদি ঠিকই বলসে তাহলে, পূর্ব ভাইয়া অসম্ভব কিছু! যার ওপর বেশিক্ষণ রেগে বা বিরক্ত নিয়ে থাকা যায়না। বাট তুই এতো তাড়াতাড়ি পূর্ব ভাইয়ের ফ্যান হয়ে যাবি তা আশা করিনাই রে দোল!

অরিনের কথা শুনে ঠাস করে ওর পিঠে একটা থাপ্পড় দেই! ও পুনরায় ব্যাথায় চোখমুখ খিচে নেয়।
আমি তেতে বলি,,,,

— লাইক সিরিয়াসলি! পূর্ব ভাইয়ার ফ্যান হবো তাও আমি?সে কি কোনো সেলিব্রিটি নাকি হুহ্?

অরিন পিঠ ডলতে ডলতে বলল,,,,

— সেলিব্রিটিই তো! জানোস না? কানাডার রাজধানী ক্যালগ্যারীতে সবাই ভাইয়াকে চিনে ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট হিসেবে। ভার্সিটিতে ভাইয়ার প্রচুর নাম ডাক। কার রেসে সব সময় ফাষ্ট! ফিজিক্স এর মতো কঠিন সাবজেক্ট এ এক্সাম দিয়ে স্বর্ণপদক পাইছে! টরেন্টো তেও ভাইয়াকে সবাই পূর্ব ভাইকে হিরো মানে ইউ নো? ভাইয়ার এমন কোনো মেধা নাই যা তার কাছে নাই!

আমি থ! মাই গড! এ দেখি সত্যিই সেলিব্রিটি। টরেন্টো আর ক্যালগ্যারীর মতো দেশে তাকে সবাই এতোটা মানে?

আমি নিজেকে সামলে বলি,,,,

— সো হোয়াট? আই ডোন্ট কেয়ার!

— বইন তুই একটা এলিয়েন। এনিওয়ে দেখিস পূর্ব ভাইয়াকে দেখে আবার প্রেমে পড়িস না। শুনছি ভাইয়া নাকি প্রচুর হ্যান্ডসাম দেখতে। পুরাই হিরো! আহা…!

আমার বিরক্ত লাগছে অরিনের কথায়। সবাই শুধু পূর্ব পূর্ব কেনো করছে?উফ…বিরক্তিকর! জেলাসি ফিল হচ্ছে। যদিও জেলাসি ফিল করার মানে হয়না। কারণ বাড়ির প্রতেকটা মানুষ আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে! তাদের আত্না আমি এজ মাম্মা সেইড!

_____________________________

সন্ধ্যা নেমেছে ধরণীর বুকে! ছাদে দাঁড়িয়ে সৌন্দর্য দেখছি। এটা আমার অভ্যাস।

রুমে আসতেই নজরে পড়লো বেডে পড়ে থাকা কালো গাউনটার দিকে। ভ্রু কুচকে আসলো আমার! এই ড্রেসটা আমার রুমে কেনো?কে রাখলো?

তখনই দেখলাম অরিন রুমে আসছে হেলতে দুলতে! ওর শরীরেও একটা গাউন জরানো। তবে সেটা লাল কালার! অরিন আসতেই আমি বলি,,,

— অরিন? এই গাউন টা আমার বেডে রাখা কেনো? কার গাউন এটা?

— এটা তোরই, বড় চাচু দিয়েছে। জলদি পরে রেডি হয়ে নে! আমরা ফাইভ স্টার হোটেলে যাবো!

— কিহ্? কেনো?

— পূর্ব ভাইয়ার জন্য! ভাইয়াকে ওয়েলকাম করতে ফাইভ স্টার হোটেল বুক করেছে চাচু।

ভ্রু দুটো বেশ কুঁচকে আছে আমার!
বিরক্তিতে কিনা রাগে তা আপাতত জানা নেই। আমি অরিন কে বলি,,,

— হোটেলে ওয়েলকাম করার কি আছে?সকাল থেকে যে বাসা এতো ধোঁয়া মোছা করলো তার কি?

অরিন ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে চুল ঠিক করতপ করতে বলল,,,

— সেটা তো করেছে পূর্ব ভাইয়া অপরিস্কার কিছু পছন্দ করেনা এজন্য! হোটেলে কি আমরা থাকতে যাচ্ছি? সেই বাসাতেই তো আসতে হবে নাকি?

— এক্সাক্টলি! তাহলে হোটেলে ওয়েলকাম করার কি আছে? বাসাতেই তো করলে হয়। সেই এই বাসাতেই তো থাকবে নাকি?

আমার কথা ফাঁদে পড়ে গিয়ে অরিন ভ্যাবাচেকা খায়। পরিশেষে বলল,,,

—ধুরর…!এতো কথা পেঁচাস কিভাবে?এজন্যই তো গল্পে এতো পেচ দিস! প্যাচের রানী কোথাকার!

— থাপ্পড় মারবো! আমার লেখালেখি এখানে টানবিনা।

— হুহ! যা ভাগ। রেডি হয়ে জলদি নিচে আয়। আমি গেলাম!

অরিন চলে যেতেই বেডে বসে পড়ি। রাগ লাগছে সাথে বিরক্তও! তবুও কি করার? জলদি রেডি হয়ে সেই কাঙ্খিত হোটেলে পৌঁছে যাই!

_______________________________

হোটেলে এসে অন্ধকারে বসে আছি। গ্রাউন্ড ফ্লোরের সব লাইট অফ করা। যখন পূর্ব ভাইয়া আসবেন ঠিক তখনিই লাইট অফ করে তাকে ওয়েলকাম জানানো হবে!

পূর্ব ভাইয়ার বড় ভাই অভ্র গিয়েছেন তাকে আনতে। এসেও পড়েছেন প্রায়। আমি বিরক্ত হয়ে দরজা দিয়ে বাহিরে চলে যাই!

[পূরব নামটা পাল্টে অভ্র দেয়া হয়েছে ]

হোটেলের গার্ডেনে পায়চারি করছি। হটাৎ দেখলাম গ্রাউন্ড ফ্লোরের লাইট অন হলো। সাথে কয়েকজন এর চিৎকার ভেসে আসলো কানে! নিশ্চিত পূর্ব ভাইয়া এসেছেন!

হটাৎ আমার মন নিভৃতে কৌতূহল জন্মে উঠলো! পূর্ব ভাইয়াকে দেখার জন্য মনটা আনচান করছে। অদ্ভুত লাগছে নিজেরেই ব্যাবহারে। জীবনে প্রথম কোনো ছেলেকে দেখার জন্য আমার হৃদপিন্ড জোরে জোরে স্পন্দিত হচ্ছে!

পা টিপে টিপে ভিতরে প্রবেশ করলাম! কাচ ভিড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই সর্বপ্রথম নজরে এলো মাঝখানে দাড়িয়ে থাকা সাদা শার্ট পরিহিত সাথে ব্লাক ড্যানিম প্যান্ট, কালো ব্লেজার আর হাতে কালো ফিতার একটা স্টাইলিশ ঘড়ি পড়নে! ছেলেটে মৃদু হেসে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে সবার সাথে কথা বলছে। কপালের কাছে কিছু চুল পড়ে আছে! তার একহাত অন্য পকেটে! স্টাইল দেখে টুপটাপ জীবনে প্রথমবার ক্রাশ খেলাম! আহা….কি সৌন্দর্য! চোখের মনিদুটো নীল বর্ণের!

আচ্ছা? ইনিই কি তাহলে পূর্ব ভাইয়া?বড় চাচুর ছেলে?

হটাৎ বড় চাচু আমার দিকে তাকান। হেসে হাত নাড়িয়ে ডেকে বললেন,,,,

— প্রিন্সেস! ঐখানে কেনো দাড়িয়ে তুমি?এদিকে এসো! পূর্বের সাথে পরিচিত হও!

ঠিক সেই মূর্হতে ঐ ছেলেটি আমার দিকে তাকায়! অমায়িক দৃষ্টি তার। ঠোঁটের হাসিটা বিলুপ্ত হয়ে কেমন স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে।

আমি আমার কালো গাউনটা উচু করে ধীর পায়ে আগাই সেদিকে!

চলবে!