স্বপ্নছায়া ২ পর্ব-০১

0
921

#স্বপ্নছায়া
#দ্বিতীয়_খন্ড
#সূচনা_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি

১.
গভীর রাতে মেয়ের কান্নায় ঘুম ভেঙ্গে গেলো ঐন্দ্রিলার। দেড় বছরের অদ্রিটা অবিরাম কাঁদছে। ছোট্টমুখখানা লাল হয়ে গিয়েছে তার। একটু আগেই চোখ লেগেছিলো ঐন্দ্রিলার। কান্না কর্ণপাত হতেই ধরফরিয়ে উঠে গেলো সে। তখন খেয়াল করলো মেয়ের পাশের জায়গাটি ফাঁকা। ঐন্দ্রিলা অদ্রিকে কোলে নিতে নিতে অনুভব করলো মেয়ের গায়ে ধুম জ্বর। আতংকিত চোখে চারপাশটা দেখলো সে। নাহ, মানুষটি নেই ঘরে। অভ্রকে না দেখতে পেয়ে ঐন্দ্রিলার চিন্তা বাড়লো। এই গভীর রাতে লোকটি কোথায় গেলো? এর মাঝেই অদ্রির কান্নার জোড় বাড়লো। ঐন্দ্রিলা তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলো কিন্তু কিছুতেই সে থামলো না। উপায়ন্তর না পেয়ে সে অদ্রিকে কোলে নিয়েই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। মায়ের ওম পেয়ে অদ্রির কান্না স্লথ হলো। সে হিচকি তুলছে। বসার ঘরে যেতেই দেখলো দিশানের ঘরের লাইট জ্বলছে। ঐন্দ্রিলা এগিয়ে গেলো রুমের দিকে। দরজাটা ঠেলতেই দেখলো, অভ্র দিশানকে জড়িয়ে শুয়ে আছে। অভ্রের এরুপ কাজে বেশ অবাক হলো ঐন্দ্রিলা। দিশানের রুমটা বেশি দূরে নয়, আহানার রুমের পাশেই রুমটা। আহানার বিয়ে হবার থেকেই দিশানকে আলাদা ঘর দেওয়া হয়েছে। তার বয়স এখন সাড়ে সাত বছর। তাই অভ্র ই তাকে আলাদা ঘরটি দিয়েছে। অথচ এখন সেই মাঝ রাতে এই ঘরে শুয়ে আছে। পরমূহুর্তে প্রশ্নগুলো মন থেকে ঝেড়ে ফেললো ঐন্দ্রিলা। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো অভ্রের দিকে। হালকা ধাক্কা দিতেই অভ্র ধরফরিয়ে উঠলো। চোখ খুলে ঐন্দ্রিলাকে দেখে সে এমন ভাবে চমকে উঠলো যেনো ভূত দেখেছে। ঐন্দ্রিলা ধীর কন্ঠে বললো,
— “ভয় পেলেন নাকি? আমি ঐন্দ্রিলা”

অভ্র ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো ঐন্দ্রিলার দিকে। কিয়ৎকাল পর নিজেকে ধাতস্থ করে স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
— “তুমি এখানে?”
— “অদ্রির জ্বর এসেছে আবার! কিছুতেই কান্না থামাচ্ছিলো না। তাই আপনাকে খুজতে এসেছিলাম”

অভ্র হাত খানা এগিয়ে দিয়ে বললো,
— “দাও ওকে আমার কাছে”

সত্যি অদ্রির অনেক জ্বর। কপালটা পুড়ে যাচ্ছে। ক্লান্ত বাচ্চাটি মায়ের উষ্ণতায় ঘুমিয়ে পড়েছে। অভ্র উঠে থমথমে কন্ঠে ঐন্দ্রিলাকে বললো,
— “দিশানের গায়ে কম্বল টেনে দাও”

ঐন্দ্রিলা তাই করলো। দিশান ঘুমোচ্ছে, নিশ্চিন্তের ঘুম। সময় কতটা দ্রুত কাটে, দেখতে দেখতে ছেলেটার সাত বছর হয়ে গিয়েছে। ঐন্দ্রিলা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। তারপর বাতি জ্বালানো অবস্থায় দরজা ভেজিয়ে দিলো।

ঘরে আসতেই দেখলো অভ্র মেয়েকে দিয়ে হাটছে। ঐন্দ্রিলাকে দেখতেই বললো,
— “ঔষধটা খাওয়িয়েছিলে?”
— “আস..লে ওর তো দুদিন ধরে জ্বরটা ছিলো না। আমি ভাবলাম, আর হয়তো ঔষধ খাওয়ানোর দরকার নেই। তাই রাতে আর ঔষধটা দিলাম না”

ঐন্দ্রিলার কথাটা শুনে তাকে অবাক করে ঈষৎ রুঢ় কন্ঠে বললো,
— “ডাক্তার কি তোমাকে বলেছিলো মাতব্বরি করতে?”
— “নাহ! আসলে, আমি ভাবলাম”
— “এতোটা ভাবার দরকার নেই। এখন তোমার ভাবার কারণে আমার মেয়ে সাফার করছে”

অভ্র বেশ ঝাঝালো স্বরেই কথাটা বললো। ঐন্দ্রিলা এক রাশ বিস্ময় নিয়ে তাকালো অভ্রের দিকে। সে অভ্রের এই আচারণটা হজম করতে পারলো না। ঈষৎ শীতল কন্ঠে বললো,
— “আমাদের মেয়ে অভ্র। আমি বুঝতে পারছি না আপনি এভাবে কথা কেনো বলছেন? আমি তো এর বাচ্চা সামলাই নি। ওর দু দিন ধরে জ্বর ছিলো না বলেই আমি আজকে খাওয়াই নি। তার জন্য আপনি এভাবে আচারণ করছেন কেনো?”

ঐন্দ্রিলার কন্ঠে শীতলতার সাথে এক রাশ অভিমান ও ছিলো। যা অভ্রের দৃষ্টি এড়ালো না। অভ্র দীর্ঘ কয়েক নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো৷ আজকাল হুটহাট ই তার রাগ হয়। কেনো হয় সেটা জানা! কিন্তু কাউকে বলতে পারছে না। ঐন্দ্রিলা তীর্যক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টিতে ঈষৎ অবিশ্বাস, ক্ষোভ, অভিমান মিশ্রিত। অভ্রের এতোটা রুঢ় না হলেও চলতো। নিজেকে সামলে অভ্র ধীর স্বরে বললো,
— “তুমি ক্যাবিনেট থেকে ঔষধটা নিয়ে আসো। এখন খাওয়িয়ে দিলে সকালে জ্বর থাকবে না।

ঐন্দ্রিলা কিঞ্চিত হতাশ হলো। অভ্রের সাথে তার বিয়ের পাঁচটা বছর কেটে গিয়েছে। হ্যা, পাঁচ বছর। সময়টা হয়তো খুব বেশি নয়, কিন্তু খুব একটা কম ও নয়। কিন্তু এই কদিন অভ্রকে বেশ অন্যরকম ঠেকছে ঐন্দ্রিলার কাছে। সব সময় গভীর চিন্তায় মগ্ন থাকে, জিজ্ঞেস করলে লুকিয়ে যায়। হুটহাট সামান্য বিষয়ে রেগে যায়। আবার সেই রাগ নেমেও যায়। অভ্রের রগচটা আচারণ সম্পর্কে ঐন্দ্রিলা বেশ ভালো করেই জানা আছে, কিন্তু এখন রুদ্রের আচারণ গুলো বড্ড বিচিত্র। ঐন্দ্রিলা দীর্ঘশ্বাস ফেললো, কথা বাড়াতে ইচ্ছে হচ্ছে না। সারাদিন বাচ্চাদের পেছনে কাটাতে কাটাতে তার সত্যি ক্লান্ত লাগছে। সেই ক্লান্তির মাঝে স্বস্তির এক দলা উপায় অভ্র। সেই অভ্রের সাথেই যখন তার বিবাদ হয় তখন সত্যি নিজেকে অসহায় লাগে তার। মনের আকাশে কিছু নিকষকৃষ্ণ মেঘ জড়ো হলো। অভিমানের ঘড়াটা জমছে। হয়তো আর একটু হলে ভেঙ্গেও যাবে। ঐন্দ্রিলা কথা না বাড়িয়ে ঔষধ আনলো। অভ্র বেশ নিপুন হস্তে মেয়েকে ঔষধ খাওয়িয়ে দিলো। মেয়েটি বাবার বুকের সাথে লেপ্টে আছে। অভ্র তাকে নিয়ে হাটছে। অদ্রিটা হয়েছে একে বারে অভ্রের মতো। সেই চোখ, সেই ঠোঁট, সেই অমায়িক হাসি। শুধু রঙ্গখানা মায়ের মতো, শ্যামলা। ঐন্দ্রিলার আজ ও মনে আছে সেই দিনটা, যেদিন প্রথম অদ্রিকে কোলে নিয়েছিলো অভ্র। আকাশের চাঁদ হাতে পাবার মতো খুশি হয়েছিলো সে। ঐন্দ্রিলা অবাক নয়নে তার স্বামীকে দেখছিলো। গাঢ় চোখে এক দলা সুখের নোনাজল জড়ো হয়েছিলো তার। এখনো সেই পিতাটিকেই দেখতে পাচ্ছে ঐন্দ্রিলা। শুধু তার স্বামীটি কোথাও যেনো ম্লান হয়ে গিয়েছে। কথাটা মনে পড়তেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঐন্দ্রিলা। তারপর ধীর গলায় বলে,
— “ওকে আমার কাছে দিন। আপনি ঘুমিয়ে পড়তে পারেন। আগামীকাল অফিস আছে”

ঐন্দ্রিলার কথায় কিয়ৎকাল চুপ করে রয় অভ্র। তারপর বলে,
— “কাল অফিস যাচ্ছি না। ঈদ্রিশ সামলে নিতে পারবে”

ঐন্দ্রিলা ছোট একটা “ওহ” বলে অদ্রির বালিশটা ঠিক করে দিলো। অভ্র কিছু সময় বাদে খাটে বসতে বসতে বললো,
— “অদ্রি ঘুমিয়ে গেছে, তুমি ঘুমিয়ে যেতে পারো।”

ঐন্দ্রিলা ছোট একটা “হু” উত্তর দিলো। সব গুছিয়ে নিয়ে অদ্রিকে অভ্রের কোল থেকে নিয়ে নিলো। তারপর তাকে আলতো করে শুইয়ে দিলো। অভ্র অপরাধীর ন্যায় ঐন্দ্রিলার দিয়ে চেয়ে রয়েছে। মেয়েটিকে অনেক ক্লান্ত লাগছে। চোখের নিচে ছাপ পড়ে গিয়েছে। দুটো বাচ্চাকে সামলানো চারটে খানি কথা নয়। শারমিন বেগমের বয়স হয়েছে, ফলে তাকেও চাপ দিতে পারে না সে। একা হাতে সকাল থেকে কাজ করে, অদ্রি হবার পর চাকরিটাও ছেড়ে দিয়েছে ঐন্দ্রিলা। তার চব্বিশ ঘন্টা এই পরিবারের মানুষের পেছনেই কাটে। তার মাঝে অভ্রের এরুপ আচারণ একেবারেই শোভা পায় না। অভ্র খানিকটা চাপা স্বরে বললো,
— “ঐন্দ্রি, সরি”

অভ্রের কথাটা কর্ণকুহরে ঝংকার তুললো৷ কেনো জানি বুকটা হু হু করে উঠলো ঐন্দ্রিলার। জমায়িত অভিমানী মেঘেরা বৃষ্টি নামাতে ব্যাস্ত। ঐন্দ্রিলার উত্তর না পেয়ে অভ্র উঠে গিয়ে ঐন্দ্রিলার জায়গায় গিয়ে বসলো। তার সন্নিকটে গিয়ে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরলো তাকে। ঘাড়ে মুখ গুজে বললো,
— “অহেতুক বাঘিনীটার সাথে চেচিয়ে উঠেছি। খারাপ ব্যাবহার করে ফেলেছি। আসলে ওই মূহুর্তে মাথা ঠিক ছিলো না। অদ্রির জ্বরটা আবার উঠেছে তাই মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিলো। সরি”

এবার আর ঐন্দ্রিলা চুপ করে থাকতে পারলো না। উঠে বসলো সে। তার চোখজোড়া অশ্রুসিক্ত। জড়ানো গলায় বললো,
— “প্রতিবার একই ঘটনা ঘটে অভ্র। আপনার রাগ হয়, আপনি সেই রাগ আমার উপর দেখান। পরে সরি বলেন। আচ্ছা আমিও তো মানুষ। প্রতিবার এই ঘটনা মানতে মানতে আমি ক্লান্ত। জানি আপনি ব্যাস্ত থাকেন। বহু কাজ থাকে আপনার। কিন্তু এই কদিন ধরে আমি আপনাকে যেনো চিনতে পারছি না। আপনি সারাক্ষণ কিছু চিন্তা করেন। জিজ্ঞেস করলে জানাতে চান না। তারপর প্রতিদিন এই ঘটনা ঘটে। আমিও তো মানুষ অভ্র। আমার দিকটা কি ভাবা যায় না?”

ঐন্দ্রিলার কথায় স্পষ্ট অভিমানের ছাপ রয়েছে। অভ্র আলতো হাতে ঐন্দ্রিলার হাতজোড়া তার হাতে নেয়। অপরাধীর ন্যায় ধীর স্বরে বলে,
— “তুমি কাঁদলে যে আমার নিজেকে অসহায় লাগে ঐন্দ্রিলা। এই কান ধরছি, আর হবে না”

তারপর শিশুদের মতো কান ধরে অনুনয় স্বরে কথাটা বলে অভ্র। অভ্রের এরুপ আচারণে আর রাগ করে থাকতে পারে না ঐন্দ্রিলা। স্মিত হাসি দিয়ে বলে,
— “থাক আর কান ধরা লাগবে না। অদ্রি যদি দেখে তার বাবা কান ধরে বসে আছে মান ইজ্জত আর রাখার জো পাবেন না। ঘুমোতে যান”

অভ্র ঐন্দ্রিলার কথা শুনে হেসে দেয়। তারপর কপালে উষ্ণ পরশ ছুয়ে মেয়ের পাশে শুয়ে পড়ে। এতোকিছুর মাঝে একটা প্রশ্নের কথা ভুলেই যায় ঐন্দ্রিলা। অভ্র হুট করে মাঝ রাতে দিশানের ঘরে কেনো গিয়েছিলো? দিশান কি ভয় পেয়েছে কোনো কারণে?

২.
সকাল নয়টা,
খাবার টেবিলে সকলে জড়ো হয়েছে নাস্তার জন্য। অদ্রি শওকত সাহেবের সাথে খেলছে। আহাশ সকালেই বেড়িয়ে পড়েছে। আজ তার সকাল নয়টায় ক্লাস। তাই সকাল সকাল ই বেড়িয়ে পড়েছে। এদিকে রাতে ঘুম না হবার কারণে অভ্র এখনো ঘুমিয়ে আছে। শারমিন বেগমকে চা দিয়ে ঐন্দ্রিলা দিশানকে খাওয়িয়ে দিতে লাগলো। আজ সে বায়না করেছে স্কুলে যাবে না। ঐন্দ্রিলা তাই জোর করে নি। দিশানকে খাওয়াতে খাওয়াতে হুট করে ঐন্দ্রিলার মনে কাল রাতের কথাটা মনে পড়লো। তাই সে ধীর গলায় দিশানকে প্রশ্ন করে উঠলো,
— “তুমি কি গতরাতে ভয় পেয়েছিলে সোনা?”
— “কেনো, মাম্মাম?”
— “কাল তোমার বাবা তোমার রুমে রাতে ঘুমাচ্ছিলেন, তাই ভাবলাম তুমি ভয় পেলে কিনা?”
— “বাবা তো এই কদিন ধরে রোজ রাতেই আমার ঘরে আসে। গভীর রাতে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে। মাঝে মাঝে কাঁদেও………

চলবে?

[আসসালামু আলাইকুম, অবশেষে পরীক্ষার অন্ত হলো। ফিরে এলাম নতুন গল্প নিয়ে। কেমন লাগলো জানাবেন?। ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]

স্বপ্নছায়া সিজন-০১ পড়তে লেখাটি উপর ক্লিক করুন।