স্বপ্নছায়া ২ পর্ব-১২+১৩

0
295

#স্বপ্নছায়া (কপি করা নিষিদ্ধ)
#দ্বিতীয়_খন্ড
#১২তম_পর্ব

চাকরি ছেড়ে দিচ্ছে! কথাটা শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় পিউ। মূহুর্তেই স্নায়ুকোষ হাজারো প্রশ্ন দাঁড় করায়, বাবার ঔষধের খরচা, মাসিক খরচা, যে আসছে তার খরচা। মধ্যবিত্ত মানুষের মস্তিষ্কে সবার প্রথমে যে প্রশ্নটি আসে, ঘর কিভাবে চলবে! পিউ এর মাথাতেও সেই প্রশ্নগুলোই এলো। কেনোই বা আসবে না! শরীফ সাহেবের অবসরের পর সম্পূর্ণ ঘরের দায়িত্ব নীলাদ্রির উপর এসে পড়ে। পেনশনের টাকাটা খুব বড় নয়৷ ঢাকার মতো যান্ত্রিক শহরে সেই টাকা দিয়ে অন্তত সংসার চলে না। অন্যসময় হলে হয়তো চিন্তাগুলো আসতো ও না। কিন্তু এখন একজন বাড়তি মানুষ আসছে। যার জন্য খরচ বেড়েছে। পিউ সঙ্কিত কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো,
— “হঠাৎ?”
— “কিছু কারণ ছিলো! সব থেকে বড় কারণ আমি তোকে একা রেখে এখন কোথাও যেতে পারবো না। আমাদের ফ্যামিলি রেকর্ড ভালো না। ঐন্দ্রি হবার সময় মার ব্লাড লস হয়েছে ফলে আমি মাকে হারিয়েছি; ঐন্দ্রিলার অদ্রি হবার সময় প্রচুর ব্লাড লস হয়েছে। আমরা তো আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম ও বাঁচবে। আল্লাহ রহমত করেছিলেন। তাই ও এখন আমাদের মাঝে আছে। সেখানে তুই তো জন্মগত অপুষ্ট, কিভাবে যাই বল তো! তাই রিজাইন লেটার দিয়েছি। ওরা আমাকে রাখবে না। আমি বেশ কিছু সময় ধরেই ব্যাপারগুলো বুঝেছিলাম। বস কেমন বেশ ক’বার সাবধান ও করেছিলেন। তাই আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

নীলাদ্রির দিকে এক দিকে তাকিয়ে আছে পিউ। লোকটি পাগল এটা তার জানা ছিলো। তবে আজ সেই পাগলামির মাত্রাটা বুঝতে পারলো সে। শত চিন্তার মাঝেও এক প্রশান্তির লহর বয়ে গেলো মন সমুদ্রে। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
— “সব বুঝেছি, কিন্তু এখন কি করবে? মানে সংসার, বাবা, কিভাবে সামলাবে?”

নীলাদ্রি চিন্তিত কন্ঠে বললো,
— ” দু-তিন মাস চলে যাবে। ব্যাংকে কিছু টাকা আছে সাথে বাবার পেনশনের টাকাটাও আছে। এই তিনমাসের মাঝে আমি কোনো চাকরি খুজে নিবো। খুজছি না যে তাও নয়। কিন্তু মন মতো পাচ্ছি না। চাকরির যা দর, ভালো না।”
— “আচ্ছা, নিজস্ব কিছু করা যায় না? মানে ব্যাবসা আর কি!”
— “করা তো যায় ই, কিন্তু ইনভেস্টমেন্ট? সেটা কোথায় পাবো?”
— “কতো লাগবে?”
— “কম হলেও দশ বারো লক্ষ! এটা ঢাকা শহর ম্যাডাম। সহজে কিছু হয় না। আর লস লাভ ফিফটি ফিফটি। চান্স নিবো না।”

পিউ কিছুক্ষণ চিন্তা করলো। তারপর উৎসাহিত কন্ঠে বললো,
— “আমাদের চিলেকোঠাটা আছে, রুফটপ কফি হাউস হলে কেমন হয়! আমার খুব ইচ্ছে ছিলো জানো একটা কফিশপ দিবো, সেখানে হাজারো বই থাকবে, গানের আড্ডা হবে। অনেকটা ” ঘরে বাইরে” সিনেমার মতো। এমনটা করা যায় না?”
— “আর ইনভেস্টমেন্ট?”
— “আমার গয়না গুলো। বিক্রি করলে বেশ টাকা পাবো। এখন তো স্বর্ণের দাম বেড়েছে।”
— “পাগল? খালু কতো কষ্ট করে দিয়েছে। মাথা খারাপ? শেষ পর্যন্ত বউ এর স্বর্ণ নিবো? এতো খারাপ দন আসে নি।”
— “এভাবে বলছো কেনো? আমি তো এমনিতেও সেগুলো পড়ি না, শুধু শুধু লকারে পড়ে আছে। এর থেকে যদি আমরা সেটাকে কাজে লাগাতে পারি আমার মনে হয় না মামুর তাতে আপত্তি থাকবে।”
— “অসম্ভব। আর এসবে সংসার খরচ কি উঠবে? হবে না গো। আমি বরং চাকরি খুজি। পেয়ে যাবো টেনশন করিস না”

নীলাদ্রি আবার ল্যাপটপে চাকরির বিজ্ঞাপন ঘাটতে লাগলো৷ পিউ বিবর্ণ চিত্তে বসে রইলো। আত্মগ্লানি হতে লাগলো। কেনো যেনো মনে হচ্ছে যা হচ্ছে তার জন্য। তার অসুস্থতার কারণে নীলাদ্রির চাকরি হারা হতে হচ্ছে। নিজেকে প্রচন্ড অসহায় লাগছে। চাইলেও সে নীলাদ্রিকে সাহায্য করতে পারছে না। যে সাহায্য সে করতে পারবে সেটা নীলাদ্রি গ্রহণ করতে নারাজ। নিজেকে শান্ত রাখতে পারলো না পিউ। গর্ভাবস্থায় নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ হারা হয়ে উঠে। ভরাক্রান্ত হৃদয় বারংবার তাকেই দোষীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছে। ফলে চোখ ভিজে এলো তার। ক্ষণে ক্ষণে ডুকরে উঠছে সে। নীলাদ্রি ব্যাপারটি অবলোকন করতেই ব্যাস্ত হয়ে উঠলো। উদগ্রীব কন্ঠে বললো,
— “কাঁদছিস কেনো?”
— “সব আমার জন্য হয়েছে। আমি কেনো এতোটা অসুস্থ হয়ে যাই! আমি চাই স্বাভাবিক মানুষের মতো থাকতে। কিন্তু হুট হাট এমন হয়ে যায়। আমি এতোটা অসুস্থ না হলে এমনটা হতো না”

কান্না দমকে কথা জড়িয়ে যাচ্ছে পিউ এর। নীলাদ্রি পিউ এর দিকে কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো৷ ফর্সা মুখ খানা রক্তিম হয়ে উঠেছে ক্রন্দনের দরুন, কালো নয়নজোড়ায় অশ্রুবিন্দু লেপ্টে রয়েছে। নেত্রপল্লবজোড়া নত হয়ে রয়েছে। ক্ষণে ক্ষণে নাক টানছে সে। নীলাদ্রি হাসলো ঈষৎ, আলতো হাতে তাকে টেনে বক্ষস্থলে মিশিয়ে নিলো। ঠাট্টার স্বরে বললো,
— “তুই তো বড্ড ছিঁচকাদুনে রে! তোর জন্য তো আমার বাবুরাও ছিচকাঁন্দুনে হবে। বড্ড বাজে লাগছে। এভাবে কেউ কাঁদে”

পিউ এর কাঁদার মাত্রা কমার বদলে বাঁড়লো। বেশ কিছু কিল ও পড়লো নীলাদ্রির বুকে। নীলাদ্রি এবার শব্দ করেই হাসলো। তারপর আহ্লাদ করে বললো,
— “ব্যাথা পাচ্ছি বাবুর আম্মু। দেখছিস তো বাবু! তোর মা কিভাবে আমাকে মারে! ব্যাপারনা আমার সৈন্য ও আসছে। পিউ রানী তখন কিভাবে আমাকে মারে আমিও দেখবো”
— “ইশ! যে আসছে সে আমার সৈন্য। বললেই হলো!”

কান্নার মাঝেই হেসে উঠে পিউ। হাসি আটকে অভিমানী স্বরে বলে কথাটা। নীলাদ্রি আরোও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে পিউকে। ধীর স্বরে বলে,
— “বেশ, তোর ই সৈন্য। পিউ, তুই আমার শক্তি। এভাবে কাঁদলে যে দূর্বল হয়ে পড়বো রে। দেখিস এই কালো দিনগুলো কেটে যাবে। খারাপ দিন বেশি সময় থাকে না। ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে”

পিউ লেপ্টে থাকলো নীলাদ্রির বক্ষস্থলে। লোকটাকে কখনো ভাঙ্গতে দেখে নি সে। আজও লোকটা ভাঙে নি। বরং প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হয়তো এজন্যই তাকে এতোটা বেশি ভালোবাসে পিউ। দুঃসময় নামক পাষণ্ড হয়তো কেটে যাবে। সকল কালো সরে যাবে। উদয় হবে নতুন সূর্যের। শুধু সেই নতুন দিনের অপেক্ষা। নীলাদ্রির দূর্বলতা হতে চায় না পিউ, তার পাশে শক্তি হয়ে দাঁড়াতে চায় সে। কিন্তু সন্দেহ হচ্ছে, পারবে তো সে! নাকি নিছক দূর্বলতাই হয়ে থেকে যাবে!

বিকেল ৫টা,
তেজহীন সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। নভস্থলে কমলা রঙ্গটি গাঢ় হচ্ছে। বছরের শেষের দিনগুলোয় শীতটা যেনো বাড়ছে। সোয়েটারেও শীত মানছে না যেনো। নতুন বছর আস্তে দেরি নেই। ঐন্দ্রিলা দিশানের গলায় ভালো করে মাফলার খানা পেচিয়ে দিলো। তার গানের ক্লাস শেষ হলো কিছুসময় পূর্বে। দিশানের কোমল গলায়
“আমরা সবাই রাজা” গানটি যেনো আরোও শ্রুতিমধুর লাগছিলো। ঐন্দ্রিলা ভিডিও করে রেখেছে অভ্রকে দেখাবে বলে৷ মাঝে মাঝে দিশানকে দেখে খুব আফসোস হয় তার। কেনো তার গর্ভে ছেলেটি হলো না! কিন্তু তার আবেগমাখানো কন্ঠে “মাম্মাম” ঢাকটি সব ভুলিয়ে দেয়। হয়তো এটাই মমতা!

দিশানকে নিয়ে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে ঐন্দ্রিলা। রিক্সার জন্য অপেক্ষা করছে সে। সন্ধ্যা নামার আগেই বাসায় যাবে। ওদিকে অদ্রি টাকে রেখে এসেছে। যদিও খাবার বানিয়ে এসেছে। কিন্তু মেয়ে যা দস্যু খাচ্ছে কি না কে জানে। দেখা যাবে শারমিন বেগমকে বিরক্ত করছে। দিশান হুট করে আবদার করে বসলো,
— “মাম্মাম, আইসক্রিম খাব”

ঐন্দ্রিলা খেয়াল করলো, রাস্তার ধারেই আইসক্রিমের গাড়ি। কিন্তু এই ঠান্ডায় আইসক্রিম খাওয়া মানেই জ্বরকে নিমন্ত্রণ জানানো। তাই বাধ্য হয়ে বললো,
— “আব্বু, আজ অনেক ঠান্ডা। আজ আইসক্রিম না, তোমার গলা বসে যাবে। রাত ও হয়েছে। আমরা বরং অন্য এক দিন খাই?”
— “আজ কিনে দাও না। আমি ভালো মার্ক ও পেয়েছি। পরীক্ষায় ও ভালো করেছি। প্লিজ”
— “জিদ করে না দিশান। ইনশাআল্লাহ পরদিন দিবো”

দিশানের উজ্জ্বল মুখখানা মিয়ে যায়। খানিকটা অভিমান ও হয় মায়ের উপর। তার যে আইসক্রিম খুব ভালো লাগে। ঐন্দ্রিলা রিক্সা খুজতে থাকে। গাড়িটা নিয়ে আসতে চেয়েছিলো। কিন্তু হুট করেই ইঞ্জিনে ঝামেলা হলো। তাই রিক্সাতেই বাড়ি ফিরতে হবে। যদিও এতে ঐন্দ্রিলা কিংবা দিশানের আপত্তি নেই। দিনের আলো ক্রমশ নিভতে বসেছে। দিগন্ত রাঙ্গা হয়ে উঠছে। ব্যাস্ত দিন অস্ত যাবার তাড়ায় আছে। এর মাঝেই ফোনটা বেজে উঠে। দিশানের হাতটা ছেড়ে ফোনটি বের করে ঐন্দ্রিলা। আননোন নাম্বার থেকে কল আসছে। নাম্বারটি দেখে চোয়াল রক্ত হয়ে যায় ঐন্দ্রিলার। কারণ নাম্বারটি তার চেনা। গত রাতে এই নাম্বার থেকেই ফোন এসেছিলো। লাস্ট সংখ্যা “৮৯০”। ঐন্দ্রিলা কিছু একটা ভেবে ফোন রিসিভ করে। কিন্তু মূহুর্তেই সে নিরাশ হয়। কারণ অপরপাশ থেকে কোনো সাড়া শব্দ নেই। ঐন্দ্রিলা ” হ্যালো” “হ্যালো” বলে কিন্তু সাড়া পায় না। বিরক্ত হয়ে সে ফোনটি রেখে দেয়। তার বুঝতে বাকি নেই কেউ তাকে বিরক্ত করবার জন্যই এই কাজগুলো করছে। কিন্তু কে! জ্যানেট! জ্যানেট যদি করেও থাকে তাতে লাভ টা কি! মস্তিষ্ককোষ হাজারো প্রশ্ন ছুড়ে দেয় ঐন্দ্রিলার দিকে। ফলে কিছু সময়ের জন্য থমকে যায় সে। পরমূহুর্তে একটি রিক্সাওয়ালার রুঢ় কন্ঠে তার স্বম্বিত ফেরে। লোকটি বলে,
— “আফা যাবেন?”
— “হ্যা, গুলশান ১”
— “যাবো”

রিক্সা পেতেই সকল চিন্তা গুলো পাশে ফেলে দেয় ঐন্দ্রিলা। গদগদ কন্ঠে বলে,
— “চলো সোনা, রিক্সা….”

কিন্তু দিশানের উদ্দেশ্যে বলা কথাটা শেষ করতে পারে নি সে। কারণ তার পাশে দিশান নেই……..

চলবে

#স্বপ্নছায়া (কপি করা নিষিদ্ধ)
#দ্বিতীয়_খন্ড
#১৩তম_পর্ব

ঐন্দ্রিলা হন্তদন্ত হয়ে আশপাশটা দেখলো। সত্যি দিশান নেই। কিয়ৎকাল পূর্বে এখানেই দাঁড়িয়ে ছিলো ছেলেটি। মূহুর্তের মাঝে কথায় চলে গেলো। কলিজায় কামড় পড়লো ঐন্দ্রিলার। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়লো সে। মস্তিষ্ক কাজ করছে না। স্নায়ু স্লথ হয়ে গেলো। সে ভয়ার্ত কন্ঠে রিক্সাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলো,
— “ভাই আমার পাশে একটা বাচ্চা ছিলো! দেখেছেন?”
— “না, আফা আমি তো খেয়াল করি নাই।”

ঐন্দ্রিলা পাগলপ্রায় হয়ে খুঁজতে লাগলো দিশানকে। কিন্তু আশাহত হতে হলো তাকে। তারা যে স্থানে দাঁড়িয়ে আছে সেটা খুব একটা ব্যস্ত রোড নয়। ছেলেটাকে চোখের সামনে ছেলেধরা ধরে নিয়ে যাবে এমনটাও নয়৷ ঐন্দ্রিলা তো ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো, সুতরাং দিশানের আওয়াজ সে শুনবে না এমন তো নয়। মিনিট দশেকের মাঝেই ঘটনাটা ঘটেছে। অথচ দিশানকে এখন কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। ঐন্দ্রিলার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে লাগলো৷ অজানা নিকষকৃষ্ণ ভয়ে বুক কেপে উঠছে। গলা শুকিয়ে আসছে। দু-তিন বার জোরে জোরে শ্বাস নিলো সে! তারপর মোবাইলের থেকে দিশানের ছবিটা বের করে আশেপাশের লোক, দোকানে জিজ্ঞেস করতে লাগলো সে। কিন্তু ফলাফল শূন্য।

সময় পার হতে লাগলো। দিবসের অন্ত হলো, রাতের সূচনা হলো। দেখতে দেখতে আধ ঘন্টা পেরিয়ে গেলো ঐন্দ্রিলা এখনো দিশানের খোঁজ পেলো না। ক্রমশ চোখ ভিজে এলো তার। কেনো তখন বাচ্চাটার হাত ছাড়লো! সেটা না হলে হয়তো এতো বড় কান্ডটা হতো না। দিশান কোথায় গেলো! খারাপ চিন্তা মস্তিষ্ক এবং মনকে দূর্বল করে তুলছে। ক্লান্ত ঐন্দ্রিলা ফুটপাতের এক কোনায় বসে পড়লো। তার পা চলতে চাইছি না। শান্ত দৃষ্টিতে আকাশে চাইলো সে। অশ্রু মুক্তি পেলো নয়নজোড়া থেকে। কি করবে সে! মস্তিষ্ক যে অশান্ত। কাজ করছে না, কোনো বুদ্ধি আসছে না তার। এর মাঝেই ঐন্দ্রিলার ফোন বারংবার বেজে উঠতে লাগলো। রিংটোনের শব্দে স্বম্বিত ফিরলো তার। স্ক্রিনে অভ্রের নামটি দেখে কান্নার মাত্রা বাড়লো। কম্পিত স্বরে বললো,
— “হ্যালো”
— “ঐন্দ্রি, তোমরা কোথায়? মা জানালো এখনো বাসায় পৌছাও নি। এতো সময় লাগছে কেনো?”
— “আসলে…

ঐন্দ্রিলার কথাগুলো জড়িয়ে আসছে। ক্রন্দনের দরুন তার কন্ঠ ভেঙ্গে গিয়েছে। অভ্র খানিকটা ব্যস্ত হয়ে উঠলো, উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললো,
— “কি হয়েছে ঐন্দ্রিলা? কাঁদছো কেনো?”
— “দিশান…দিশানকে খুঁজে পাচ্ছি না। আমি আধ ঘন্টা যাবৎ ওকে খুজে যাচ্ছি”

অভ্র বিচলিত কন্ঠে বলে উঠলো,
— “কি বলছো তুমি! খুঁজে পাচ্ছো না মানে কি! আচ্ছা, এখন কোথায় আছো? আমি আসছি!”
— “ওর গানের স্কুলের পাশের গলির শেষ প্রান্তে।”
— “ওখানেই থাকো আমি আসছি”

ফোন রেখে দেয় অভ্র। হুড়মুড়িয়ে অফিস থেকে বের হয় সে। ঈদ্রিশ কিছু জিজ্ঞেস করতে যেয়েও করে না। শুধু বের হবার পূর্বে একটি কথাই বলে অভ্র,
— “ফোনটা অন রেখো”

অভ্র ঐন্দ্রিলার বলা ঠিকানায় পৌছে থেকে, ফুটপাতের এক কোনায় ঐন্দ্রিলা বসে আছে। অভ্র ছুটে যায় তার কাছে। অভ্রকে দেখে হু হু করে কেঁদে উঠে ঐন্দ্রিলা। অস্পষ্ট স্বরে বলে,
— “আমার পাশেই ছিলো ও, এর মাঝে একটা ফোন আসে। কাল রাতের নাম্বারটাই ফোন করেছিলো। আমি ফোন রিসিভ করতে ওর হাত ছাড়ি। তারপর রিক্সা ঠিক করে আমি যখন আবার ওর দিকে তাকাই ও নেই। আমি সারাটা জায়গা তন্ন তন্ন করে খুজেছি কোথাও নেই।”
— “শান্ত হও। কেঁদো না। আর মনে করে বলো এক্সাক্টলি কি হয়েছিলো? এটা কিডন্যাপিং হলে পুলিশে খবর দিতে হবে। আগে তুমি গাড়িতে উঠো।”

ঐন্দ্রিলাকে বাহু ধরে টেনে তোলে অভ্র। তার পা যেনো চলতে চাইছে না। হিম ধরে গেছে। তারপর গাড়িতে বসায় সে। পানির বোতল এগিয়ে দেয়। ঐন্দ্রিলা এক নিঃশ্বাসে বেশ পানি ই পান করে। এর পর ধীরে ধীরে পুরো ঘটনাটা খুলে বলে অভ্রকে। সম্পূর্ণ ঘটনা শুনে অভ্র বলে,
— “তুমি ওর কোনো সাউন্ড শুনেছিলে? কান্না বা চিৎকারের?”
— “আমি কিছু শুনি নি।”
— “তাহলে দিশান কোথায় ঐন্দ্রিলা। সে যদি নিজ থেকেও কোথাও যায় দশ মিনিটের ব্যাবধানে ও কোথায় যাবে? এটা কিডন্যাপিং। আর তুমিও, যখন দিশান মিসিং হয়েছে তখন তুমি কেনো আমাকে জানাও নি?তুমি তো এতোটা কেয়ারলেস নও। তাহলে আজ কি হলো!”

অভ্রের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে সেটা জানা ছিলো ঐন্দ্রিলার। আকুল কন্ঠে বলে,
— “অভ্র বিশ্বাস করো, সময়টা খুব অল্প ছিলো। মাত্র দশ মিনিটের মধ্যেই এমনটা হয়েছে। আমার মাথা কাজ করছিলো না। পাগলের মতো আমি পুরো গলি তন্নতন্ন করে খুজেছি। কিন্তু দিশানকে কোথাও পাই নি। আমার মনে হচ্ছে কেউ মারাত্নক ষড়যন্ত্র করছে। আমার কেনো যেনো সবকিছু সাজানো মনে হচ্ছে। প্রথমে এই নাম্বার থেকে ফোন। তারপর দিশানের মিসিং হওয়া। কেউ প্লান করে করেছে।”

ঐন্দ্রিলা পুনরায় ডুকরে উঠলো৷ চোখ থেকে অনবরত অশ্রু ঝরছে। অভ্র তার হাতটা শক্ত করে ধরলো, ধীর কন্ঠে বললো,
— “আমরা ওকে ঠিক খুঁজে পাবো৷ তুমি এভাবে ভেঙে পড়লে আমি কি করবো! ঐন্দ্রিলা এই সময় ভেঙ্গে পড়ার নয়৷ আমাদের পুলিশ স্টেশনে যেতে হবে।”

অভ্রের কন্ঠ কাঁপছে। ভয় তার মনেও বাসা বেধেছে। অজস্র দুশ্চিন্তা খুবলিয়ে খাচ্ছে তার ভেতরটাকে। কিন্তু এই সময়টা ভেঙ্গে পড়ার নয়। দিশানকে খুজে পাওয়াটা যে বড্ড জরুরি। না জানি কোথায় আছে ছেলেটা!!

রাত সাড়ে আটটা,
দেখতে দেখতে তিন ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। পুলিশকে খবর দেওয়া হয়েছে, ঐন্দ্রিলা সব খুলে বললে ইন্সপেক্টর হালিমের বক্তব্য,
— “এটা কিডন্যাপিং। আচ্ছা কোনো ফোন আসে নি?”

সত্যি কোনো ফোন আসে নি। তাই পুলিশের কাছে ঘঠনাটি ক্রমশ জটিল হয়ে গিয়েছে। যে নাম্বার থেকে ঐন্দ্রিলার মোবাইলে কল আসে সেই নাম্বারটি ট্রেস করা হচ্ছে। ঈদ্রিশ, আহাশ উভয় ই বেড়িয়েছে অভ্রের সাথে। বিভিন্ন থানায় দিশানের ছবি দেওয়া হয়েছে। দিশানের হারিয়ে যাবার খবরে বদরুল সাহেব, নীলাদ্রি এবং দিশা এসেছেন। ঐন্দ্রিলাকে স্বান্তনা দিচ্ছে দিশা। কিন্তু কিছুতেই অশান্ত হৃদয়কে শান্ত করতে পারছে না সে। ক্ষণে ক্ষণে বারান্দায় ছুটে যাচ্ছে সে। শরীফ সাহেব বার কয়েক ফোন করেছেন। মেয়ের বিচলিত চিত্ত আন্দাজ করতে তার বাকি রইলো না। কিন্তু সে চাইলেও কিছু করতে পারছে না। দিশানের চিন্তায় শওকত সাহেবের প্রেসার বেড়ে যাচ্ছে তাই কান্ড। তাই শারমিন বেগম তাকে প্রেসারের ঔষধ এবং ঘুমের ঔষধ দিয়েছেন। বাইরের গাড়ির শব্দে আবারো ছুটে যায় ঐন্দ্রিলা। কিন্তু আশাহত হয়ে ফিরে আসে সে। বড্ড এলোমেলো হয়ে আছে সে। অভ্রটাও ফোন ধরছে না। বাসায় থেকে মনটা আরোও বিচলিত হয়ে উঠছে তার। অদ্রিকে দিশার কাছে দিয়ে নীলাদ্রিকে আকুল স্বরে বলল,
— “ভাই ওরা ফোন দিয়েছে?”
— “নাহ, অভ্র ফোন তুলছে না”
— “আমার আর এখানে থাকতে ভালো লাগছে না। তুই আমার সাথে যাবি? আরেকটিবার জায়গাটা খুজে দেখতাম”

ঐন্দ্রি আকুল নিবেদন করে উঠে নীলাদ্রির কাছে। তাকে বড্ড উদ্ভ্রান্ত লাগছে। ঐন্দ্রিলাকে এরুপে দেখতে কিছুতেই ভালো লাগছে না নীলাদ্রির। তাই ধীর স্বরে বলে,
— “বেশ চল”

তারা বের হতেই যাবে তখনই কলিংবেল বেজে উঠে। ঐন্দ্রিলা ছুটে গিয়ে দরজা খুলে। দরজা খুলতেই দিশান উৎফুল্ল চিত্তে ছুটে আসে তার দিকে। দিশানকে দেখে যেনো ঐন্দ্রিলার ধরে প্রাণ আসে। হাটু ভেঙ্গে বক্ষস্থলে জড়িয়ে ধরে তাকে। হাজারো চুমুতে ভরিয়ে দেয় তার মুখশ্রী। কিন্তু দিশানকে দেখে যতটা খুশি হয় সে, তার থেকে বেশি অবাক হয় তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা নারীটিকে দেখে। দিশানকে আর কেউ নয় বরং জ্যানেট ই নিয়ে এসেছে বাসায়…….

চলবে

[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন৷]

মুশফিকা রহমান মৈথি