স্বামী পর্ব-০৪

0
151

#স্বামী
পর্ব : ০৪
#মেঘা_মেহেরাব

মুখ থেকে ওড়না সরিয়ে চিৎকার করতে গেলে ই জলিল মিয়া মুখ চেপে ধরে রাখছে। যতটুকু আওয়াজ বাইরে যাচ্ছে তাতেও কাজ হচ্ছে না কারণ সবাই তখন নুরাইসার বাড়িতে আগুন নেভাতে ব্যস্ত। জলিল মিয়া নিজের সর্ব শক্তি দিয়ে নুরাইসার দুই হাতের বাজু চেপে ধরে। ব্যাথায় কুঁকড়ে ওঠে নুরাইসা। চিকন গড়নের শরীর তার উপর তিন দিন ধরে তেমন কিছু পেটে পরে নি তার শরীরে কোন শক্তিও যেন আজ কাজে লাগবে না মনে হচ্ছিল।

রাসেল হাওলাদার সংগ্ৰহ করা কিছু বস্তা নিয়ে আবার ও ভেতরে যায়, বেগম এর অর্ধ পোড়া শরীর বস্তা দিয়ে পেঁচিয়ে বের করে আনে‌ । আসার সময় একবার পুরো ঘরে চোখ বুলিয়ে নেয় নুরাইসাকে খোঁজার জন্য। তবে রাসেল হাওলাদার বুঝতে পারে এখানে কোথাও নুরাইসার অস্তিত্ত্ব নেই। পুরে যাওয়া ঘর থেকে বেগম এর মরা দেহ টা বের করে আনার সময় রাসেল হাওলাদার এর শার্টের পেছনে সহ দুই হাতের বাহু তে আগুন লেগে যায়। বেগম এর দেহ মাটি তে রেখে নিজে মাটিতে কয়েক বার শুয়ে পাল্টি খেলে আগুন নিভে যায়। নুরাইসার বাবা বেগম এর পোড়া লাশ দেখে “নাআআআ” বলে এক চিৎকার দিয়ে বেগম কে বুকে জড়িয়ে নেয়। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে নুরাইসা কে ডাকেন তিনি। কিন্তু কোথাও বাড়ির কোন জায়গায় নুরাইসার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। রাসেল হাওলাদার দ্রুত কি মনে করে দৌড়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়, রাইবাদের কবর দেওয়া হয়েছে যেখানে তার উদ্দেশ্য।

জলিল মিয়া নুরাইসাকে নিচে ফেলে দুই হাত ঝাপটে ধরে যখন তার গলায় মুখ নেয় নুরাইসা নিজেকে বাঁচাতে আর একবার শেষ চেষ্টা করে হাঁটু দিয়ে আঘাত করে জলিল মিয়ার পুরুষাঙ্গে। সঙ্গে সঙ্গে জলিল মিয়া নুরাইসার উপর থেকে পুরুষাঙ্গ ধরে চিৎকার দিয়ে পাশে সরে আসে। নুরাইসা আর সময় নষ্ট না করে উঠে হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়ে বেরিয়ে আসে গোলা থেকে। নিজের বাড়িতে আসার উদ্দেশ্য এগোতেই জলিল মিয়া পেছন থেকে এসে আবার ধরে নেয় নুরাইসাকে। বিশ্রী ভাষায় কিছু গালি দিতে থাকে নুরাইসাকে‌। টানতে টানতে আবার নিয়ে যায় সেই গোলার ভেতরে।এক টানে নুরাইসার জামা ধরে টান দিতেই হাতা ছিঁড়ে যায়। হা হা হা করে হেসে দেয় জলিল মিয়া। নুরাইসা জলিল মিয়ার পায়ের কাছে পরে আকুতি মিনতি করতে থাকে। পালানোর একটি মাত্র দরজা সেখানেই জলিল মিয়া দাঁড়িয়ে আছে। উপায়ন্তর না পেয়ে জলিল মিয়া কে নুরাইসা বলে

– আপনে আমার বাপের মতো, আমার লগে এমন করবেন না। আমাদের বাড়িতে আগুন লাগছে যাইতে দেন আমারে….( কান্না করতে করতে বলল নুরাইসা)

জলিল মিয়া নুরাইসার এমন কথায় যেন মায়ার থেকে মজাই বেশি পেলো। ধাক্কা দিয়ে নুরাইসা কে নিচে ফেলে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পরলো জলিল মিয়া। নুরাইসা শুধু চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো_

– আল্লাহ গো আমারে বাঁচাও এই নরপিশাচ এর হাত থাইকা..

রাসেল হাওলাদার সবে নুরাইসাকে যেই বাড়ির গোলার ভেতরে আনা হয়েছে সেখান থেকে পার হচ্ছিল এমন সময় ধস্তাধস্তি আর ” বাঁচাও” শব্দ কানে আসতেই রাসেল হাওলাদার বলে ওঠে

– কে ? কে এখানে?( জোরে চিল্লিয়ে বলল)

নুরাইসা কারোর আসার আভাস পেয়ে আরো জোরে চিৎকার দেয় একবার, পরের বার চিৎকার দিতেই জলিল মিয়া নুরাইসার মুখ চেপে ধরে রাখে ।নুরাইসা নিচ থেকে গোলার ভেতরে ধানের ধুলো এক হাত দিয়ে কুড়িয়ে ছুঁড়ে মারে জলিল মিয়ার চোখে । আংশিক নুরাইসার এমন কাজের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না জলিল মিয়া। নুরাইসা আবার চিৎকার দিয়ে ওঠে । রাসেল হাওলাদার কোন মেয়ে মানুষের কন্ঠ শুনে এগিয়ে এসেই দেখে গোলার ভেতর থেকে আওয়াজ আসছে। গোলার দরজা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে দেখে নুরাইসার শরিরের উপর জলিল মিয়া উঠে বসে হাত দিয়ে নিজের চোখ ডলছে।

কু**বাচ্চা বলে এক চিৎকার দিয়ে এগিয়ে এসে এক লা’ থি দিলো জলিল মিয়ার বুকে। ছিটকে পরলো জলিল মিয়া।এক কোনায় টিনের ভাঙ্গা জং ধরা একটা বালতি পরে থাকতে দেখে বালতি এনে একেরপর এক আঘাত করতে থাকে জলিল মিয়ার শরিরে।নুরাইসার সেলোয়ার সহ জামার হাতা খানিক টা ছেড়া বুকে ওরনা না থাকাই হাত দিয়ে নিজেকে ঢাকার বৃথা চেষ্টা করে নুরাইসা।

রাত সাড়ে তিন টা থেকে বিচার বসানোর মত করে বসে আছে প্রায় ৬০ ভাগ গ্ৰামের মানুষ। নুরাইসাকে সেই ছেঁড়া পোশাকে উঠানের এক কোনায় রাখা হয়েছে, না চোখে পানি না মুখে কোনো কথা এক কথায় মনে হচ্ছে জিবন্ত লাশ সে, তাকে ঘিরে আছে প্রায় পনের বিশ জন মহিলা। রাসেল হাওলাদার আগুনে পোড়া ক্ষত শরীর নিয়ে রাগে ফুঁসছে বাইকের সাথে হেলে এক পা উঁচু করে দাঁড়িয়ে দুই হাত আড়াআড়ি ভাজ করে আছে দৃষ্টি তার জলিল মিয়ার দিকে। নুরাইসার বাবা মাটিতে বসে এক হাঁটুর উপর এক হাতের ভরে মাথাটা ধরে নিষ্পলক ভাবে বেগমের পোড়া মরা বস্তাই পেচানো শরিরের দিকে তাকিয়ে আছে । গ্রামের তিন মোড়ল মাতব্বর এসে কাঠের ছোট চৌকির উপর বসে আছে। জলিল মিয়ার শরীরে বিভিন্ন জায়গায় গ্রাম্য ডাক্তার এসে ব্যান্ডেজ সহ প্রয়োজনীয় জায়গায় সেলাই করে দিয়েছে। মাতব্বর সাহেব দাঁত খিটমিট করে আড়চোখে তাকিয়ে আছে জলিল মিয়ার দিকে।সে বলেছিল পুরো পরিবার কে পুড়িয়ে মারতে আর এই জলিল মিয়া নিজের পাওনা মেটাতে ব্যাস্ত হয়ে তার পুরো প্লান লোপাট করে দিলো।এখন যদি জলিল মিয়া সবার সামনে বলে দেয় যে নুরাইসাদের বাড়িতে আগুন দিতে সয়ন সে নিজেই বলেছে তখন সবার সামনে তার মান সম্মান সব ধুলোয় মিশে যাবে। যদিও সবাই জানে সে কেমন ভয়ানক তবে মুখের উপর সবাই তাকে সম্মান করে কারণ টাকা পয়সা ধন সম্পদের কমতি নেই তার। টাকার ভয়ে হলেও সবাই তার সামনে মাথা নত করে এতেই তৃপ্তি মিটে যায় তার ‌।

সকালে থানা থেকে পুলিশ আসলে সবাইকে অবাক করে দিয়ে মাতব্বর সাহেব জলিল মিয়াকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেয়। জলিল মিয়া ভয় পেয়ে মাতব্বর সাহেবের মুখোশ খুলে দিতে গেলে মাতব্বর সাহেব জলিল মিয়া কে চোখ রাঙ্গিয়ে শাসায় ইশারায় বলে চুপ করে থাকতে সে পরে দেখবে তার যেন কিছু না হয়। পুলিশ সব কিছু যাচাই করে যত টুকু জানতে পারে তা হচ্ছে, রাতের খাবার খেয়ে সবাই যখন ঘুমিয়ে পরে তখন নুরাইসা ঘাটে কোন এক ছেলের সাথে দেখা করতে যায় । সেই রাস্তা দিয়ে আসার পথে জলিল মিয়া তাদের ধস্তাধস্তি করতে দেখে এগিয়ে গেলে ছেলে টি পালিয়ে যায়। জলিল মিয়া নুরাইসার হাত ধরে টানতে টানতে বাড়িতে আনার চেষ্টা করলে নুরাইসা জলিল মিয়ার হাতে কামড় দিয়ে পালিয়ে যায় সেই গোলার ভেতরে। জলিল মিয়া খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছায় সেখানে। গত রাতে জলিল মিয়া তাল গাছের ঘোলা রস বা তাড়ি বলে সেটাই খাওয়ার ফলে তার ঘোর লেগে আসে নুরাইসা কে দেখে। তখনই ঝাঁপিয়ে পড়ে নুরাইসার উপর। আর আগুন লাগার কারণ হিসেবে জানতে পারে ,রাতে বেগম রান্না করে ভিজা লাকড়ি চুলাই শুকাতে দেওয়াতে এই ভয়াবহ আগুন বিস্তার করে সারা বাড়ি ছড়িয়ে যায়। আগুন লাগার অনেক আগেই নুরাইসা বাড়ির বাইরে থাকায় সে জানতো না তাদের বাড়িতে আগুন লেগেছে। পুলিশের লেখা লেখি শেষ হবার পর বেগমের পোড়া লাশ যত দ্রুত সম্ভব দাফন করার কথা বলে তারা চলে যায় জলিল মিয়া কে নিয়ে সেখান থেকে। নুরাইসা নির্বোধের মতো চুপ করে থাকায় সবাই এসব ঘটনা সত্য বলে মনে করেন। নুরাইসার বাবা নুরাইসাকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে তিনি ও ধরে নেন হয়তো সবাই যা বলছে তা সত্য নয়তো যে মেয়ের নামে এমন মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হচ্ছে সে কি করে ওভাবে চুপ করে থাকতে পারে? নিশ্চয়ই সে খারাপ কিছু করতেই নিজের ঘর থেকে রাতে অন্ধকারে বাহির হয়েছে। নিজে বের না হলে অন্য কেউ তো আর ঘর থেকে তাকে বের করা সম্ভব না ।কারন বেড়ার দরজা ভিতর থেকে নুরাইসা লাগিয়ে ঘুমাই। সাধাসিধে সোজা সরল মনের মানুষ নুরাইসার বাবার মাথায় এটা আসে নি বেড়া কেটে তার মেয়ে কে ঘর থেকে বের করা হয়েছিল।হঠাৎ করে মাতব্বর সাহেব বলে উঠেন

– এমন দুশ্চরিত্রা অপপায়া অলক্ষী কোন মেয়ের জায়গা আমাদের এই গ্ৰামে হবে না। এই মেয়ে কে এক কাপড়ে এই গ্ৰাম ছাড়তে হবে। আর এমন মেয়ে জন্ম দেয়ায় অপরাধে তার বাবাকে…

আর বলতে পারলো না ,য়রাসেল হাওলাদার মাতব্বর সাহেবের সামনে এসে দাড়িয়ে নুরাইসাকে হাত দিয়ে দেখিয়ে বললো

– কি বলছেন আপনি বাবা এসব? দুশ্চরিত্রা, অপয়া, অলক্ষী ?একটা অসহায় দূঃখি মেয়ের পাশে না দাঁড়িয়ে আপনি তাকে গ্রাম ছাড়তে বলছেন? এতোটুকু বয়সে কোথায় যাবে মেয়েটা একবারও ভেবে দেখেছেন?

– হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ ! দুশ্চরিত্রা বলছি কারণ রাতের অন্ধকারে এই মেয়ে পুকুরপাড়ে ঘাটে ধরা ধরি করছিলো একটা ছেলের সাথে নিজের চোখে দেখেছে জলিল মিয়া , এতগুলো মানুষের সামনে বলল তুমি শুনলে না? অপয়া বলছি এর জন্য এই মেয়েটার ইচ্ছা পূরণ করতে গিয়ে ১২ ১৩বছরের ছোট্ট বাচ্চা ছেলে রাইবাদ আম চুরি করতে গিয়ে অকালে তার মৃত্যু ঘটেছে , অলক্ষী বলছি এর জন্যই যে এই মেয়ের মত অলক্ষী মেয়েকে বাঁচাতে তার মা প্রাণ দিয়েছে।

শক্ত গলায় বলল মাতব্বর সাহেব। গ্রামের মানুষের মধ্যে কানাঘুষা শুরু হয়ে গেল মাতব্বর সাহেবের এমন কথাই। শোর গোল শোনা গেল সবার মাঝে। রাসেল হাওলাদার এর তীব্র রাগে শরীর যেন ফেটে পড়ছে। ওই নরপশু জলিল মিয়ার কথায় তার বাবা অসহায় একটা মেয়েকে অবিশ্বাস করছে। একবারো মেয়েটার পরিস্থিতির কথা বোঝার চেষ্টা করছে না কেউ। মেয়েটা যে এখনো নির্বোধের মতো চুপ করে বসে আছে যেন সে এক জীবন্ত লাশ। নিজে প্রাণপ্রিয় একমাত্র খেলার সাথী সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার সঙ্গী আপন মায়ের পেটের একমাত্র ভাই কে হারিয়ে পাগলের মত উম্মাদ হয়ে গেছে সে। তিন টা দিন ও পার হতে পারে নি মানুষরূপী অমানুষ জলিল মিয়া তার সবচেয়ে বড় সম্পদ তার মান সম্মান কেড়ে নিতে চেয়েছে , কতটা ধকল গেছে একমাত্র সেই মেয়ে জানে । কোন রকম নিজেকে বাঁচিয়ে যখন ঘরে ফিরে আসলো চোখের সামনে তার ছোট থেকে বড় হওয়া শেষ আশ্রয় স্থল নিজ গৃহে আগুনে পুড়ে ছাই হতে দেখেছে। মা বলে চিতকার দিয়ে যে মায়ের বুকে হুমরি খেয়ে পরে কাঁদবে সেই মা যখন পোড়া লাশ হয়ে সামনে পরে থাকতে দেখে সেই মেয়ের মুখে কি কোন কথা থাকে? থাকে না । কিন্তু কেন কেউ মেয়েটার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে তার কষ্টটা অনুভব করছে না? কেন ওই মেয়েটার ছেঁড়া পোশাক পাল্টে দিয়ে তাকে নতুন পোশাক দেওয়া হচ্ছে না নিজের সম্মান বাঁচানোর জন্য? কেন ওই অসহায় মেয়েকে জন্ম দেওয়ার অপরাধে তার বাবাকে শাস্তি পেতে হবে? রাসেল হাওলাদার এর জানা মতে এত মানুষের সুষ্ঠু বিচার করা বিচারক তার পিতা কেন একটা অসহায় মেয়ের প্রতি অবিচার করছে? কেন মেয়েটার কষ্ট বুঝতে চাইছে না? কেন মেয়েটাকে গ্রাম ছাড়তে বলছে? তার নিজেরও তো দুইটা মেয়ে আছে নিজের মেয়ের বেলায় যদি এমনটা হত তাহলে কি সে এই অবিচার মেনে নিতে পারতো? তবুও সে এই অবিচার করছে, গ্রামের মানুষের মনে এই অসহায় মেয়েটার বিরুদ্ধে বিষ ঢেলে দিচ্ছে কিন্তু কেন? কেন কেন কেন? এইসব প্রশ্নের উত্তর চাই রাসেল হাওলাদার এর।

#চলবে…