হক নিবাস পর্ব-০৩

0
255

#গল্প
#হক_নিবাস
#পর্ব_৩
-শাতিল রাফিয়া

মজনু ভাইয়ের মুখে রাহাতের কথা শুনে আমার চোখমুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। মুখ থেকে রক্ত সরে গেল। আমি থরথর করে কাঁপতে লাগলাম। রাহাতের কথা আমি কাউকেই বলিনি। তবে এই মজনু ভাই কী করে জানল?

মজনু ভাই ভিলেনের মতো হেসে উঠে জিজ্ঞেস করলেন, এইবার? কথা বন্ধ শালিকা?

আমি কিছু বলার আগেই আপু ফিরে এল।

চোখ কুঁচকে জোর করে হাসি টেনে জিজ্ঞেস করল, কী কথা হচ্ছে এত শালী আর দুলাভাইয়ের মধ্যে?
এরপর আমার অবস্থা দেখে আবার জিজ্ঞেস করে, একী মধু! তুই এরকম কাঁপছিস কেন? শরীর খারাপ লাগছে?

আমি জবাব না দিয়ে কোন রকম হাঁচড়পাঁচড় করে আপুর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম।

যেতে যেতে শুনলাম আপু মজনু ভাইকে জিজ্ঞেস করছে, কী বলছিলে তুমি ওকে?

আমি আমার ঘরে ঢুকেই দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। এরপর মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে রাহাতের নম্বর বের করলাম।
কাঁপা হাতে ফোন করলাম। রাহাত ফোন না তোলা পর্যন্ত আমার হার্ট প্রচন্ড জোরে জোরে বিট করতে থাকে।

রাহাত ফোন ধরে বলল, বলো।
আমি চাপা গলায় বললাম, রাহাত! সবাই কি সবকিছু জেনে গেছে?
প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে রাহাত বলল, উফফ! মধু! তোমাকে বলেছি না এই একই কথা ঘ্যানঘ্যান করবে না?
– তবে… তবে মজনু ভাই…
রাহাত অবাক হয়ে বলল, মজনু! মজনুকে তুমি কোথায় পেলে?
আমি তার উত্তর না দিয়ে বললাম, মজনু ভাইকে তুমি কিছু বলেছ?
– বোকার মতো কথা বলবে না। ইডিয়টটাকে আমার অসহ্য লাগে। কেন ওকে বলতে যাব?

আমি রাহাতকে সব খুলে বললাম। সব শুনে সে ফ্যা ফ্যা করে হাসতে লাগলো। এরকম পরিস্থিতিতে কেউ হাসে?

আমি বললাম, হাসছো কেন?
রাহাত হঠাৎই হাসি থামিয়ে বলে, তোমার বোন একটা ফালতু টাইপ কবিকে বিয়ে করে নিয়ে আসতে পারে, আর সেখানে আমি কিছু চাইলেই দোষ? আমাকে তুমি অবিশ্বাস করো।
আমি বললাম, অবিশ্বাস করার মতো কাজ তুমি করেছ! বিশ্বাস তুমি ভঙ্গ করেছ।
– আমার বুঝি কোন ইমোশন নেই?
– অপেক্ষা করতে পারতে!
রাহাত এবার কঠিন গলায় ধমকে ওঠে, ফালতু প্যাঁচাল বন্ধ করো।

সে খটাশ করে ফোনটা কেটে দিল। আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ দিল না।
আমি ফোন রেখে চুপ করে বসে রইলাম।

রাহাতের সঙ্গে আমার পরিচয় ফোনের মাধ্যমে। কোনো একটা ফ্ল্যাক্সিলোডের দোকান থেকে সে আমাকে দেখে আমার নাম্বার যোগাড় করেছিল। সেই থেকে পরিচয়, কথাবার্তা, প্রেম। যেহেতু আমাদের বাসায় প্রেম করায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা আছে, তাই আমি নিরাপত্তার জন্য বিষয়টি আপুকেও বলিনি। আমরা দেখা করতাম লুকিয়ে। এই এলাকা ছাড়িয়ে আরো অনেক দূরে। গোসলের সময় বাথরুমে ঢুকে জোরে পানির কল ছেড়ে দিয়ে কথা বলতাম। অন্য সময় কথা বললেও অনেক সাবধানতা অবলম্বন করতে হতো। আমার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরে রাহাত একদিন অনেক দূরে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করল। আমি রাহাতকে তখন চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতাম। আমিয়ো নাচতে নাচতে রাজি হয়েছিলাম তার প্রস্তাবে।

সেইদিনের শুরুটা ছিল ছবির মতো সুন্দর। আমি যেন পাখির মতো উড়ছিলাম। আপুকে বলেছিলাম বান্ধবীর বাসায় যাব। বাবাকে বলে আপু যেন কোনভাবে ব্যবস্থা করে।
আপু বাবাকে অনুরোধ করে বলল, যেহেতু আমার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ, তাই আমরা দুইবোন শপিং করতে যাব, এরপর একসাথে সিনেমা দেখব, আনন্দ করব। আমরা আমার পরীক্ষার জন্য অনেকদিন একত্রে ঘুরতে যেতে পারিনি।

বাবা সম্মতি দিয়েছিলেন।

আমাকে একটু এগিয়ে দিয়ে আপু তার এক বান্ধবীর বাসায় গিয়ে বসে ছিল। আর আমি রাহাতকে ফোন করলাম।

সেদিন আমরা শহরের কোলাহলের বাইরে অনেক দূরে হারিয়ে গিয়েছিলাম। একটা লেকের ধারে বসে আমি রাহাতের কাঁধে মাথা রেখে বসেছিলাম।
আমরা এরপরে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করলাম, মুভি দেখলাম। রাহাত আমাকে একটা বাসায় নিয়ে এল। আমি জিজ্ঞেস করাতে ও বলেছিল ওর বোনের বাসা। পরিচয় করিয়ে দেবে। আমিয়ো ওকে সরল বিশ্বাস করেছিলাম।
সেই বাসায় যাওয়ার পরেই ও আমাকে জড়িয়ে ধরে।

আমি ওকে ছাড়িয়ে দিয়ে কঠিন গলায় বলেছিলাম, এটা কী ধরনের আচরণ!
ও বলল, আমাকে নাকী ও একটু অন্যভাবে পেতে চায়। আর আমরা তো বিয়ে করবই।
আমি রেগে বেরিয়ে আসার আগেই রাহাত আমাকে পেছন থেকে জাপটে ধরে। রাহাত আমাকে বিছানায় ফেলে দিল। এরপর সে আমার সাথে জোর করার চেষ্টা করে। আমি ঠাশ করে রাহাতকে একটা চড় লাগিয়ে দিলাম। থাপ্পড় খেয়ে সে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে! আমি তখন রাগে ফুঁসছি।

রাহাত এরপর হঠাৎই আমার পা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো মাধুরী। আমি কী করে এটা করতে যাচ্ছিলাম! ছি! আমি তো নিজেই নিজের সাথে চোখ মেলাতে পারব না।

আমার চোখে তখন তীব্র ঘৃণা।

রাহাত ভেউভেউ করে কাঁদতে কাঁদতে আবার বলল, প্লিইইজ মাধুরী! আমি স্যরি। কীভাবে যে এই ভুলটা করতে যাচ্ছিলাম! আমি নিজেও জানি না। তোমাকে এত সুন্দর লাগছে আজকে, আর একা পেয়ে, আমি… আই জাস্ট লস্ট মাই মাইন্ড। প্লিজ মাফ করে দাও।

রাহাতকে সেদিন ক্ষমা করতে পারিনি। ক্ষমা আজও করিনি। ও আমাকে কথা দিয়েছে এইসব কথা, আমাদের রিলেশনের কথা কাউকে জানাবে না। সেইদিন আমি রাহাতের সাথে কী করে একই বাইকে করে এসেছিলাম নিজেও জানি না! কাঠের পুতুলের মতো আমি বসে ছিলাম।
আপু খুব রেগে গিয়েছিল এত দেরি করেছি বলে। বাসায় আসার পর দুনিয়ার কৈফিয়ত দিতে হয়েছে। বাবা রেগে আমাদের দুইবেলা খাবার বন্ধ করে রেখেছিলেন। যদিও সমুদ্র ভাইয়া লুকিয়ে আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করেছিল। সে আমাদের জন্য খাবার কিনে এনেছিল।

আমি কারো সঙ্গে একটা কথাও বলিনি।

আপু পরে নিজেই আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে, কী রে! বান্ধবীর সাথে কি ঝগড়া হয়েছে নাকী?
আমি শক্ত করে বললাম, না। সব ঠিক আছে।

সেদিনের পর রাহাত আমাকে আরেকবার ম্যাসেজ দিয়েছে। ওকে যেন ক্ষমা করে দেই। ও নাকী সেন্সেই ছিল না। ওর নাকী বিবেচনা বোধ লোপ পেয়েছিল। আমি কথা বলিনি। সেদিনের পর আমি আজকে রাহাতকে ফোন দিলাম। আজ ওর সাথে কথা বলে আমার একবারও মনে হল না যে ও অনুতপ্ত, লজ্জিত। উল্টো আজ সে নিজের সাফাই গাইল!
রাহাত যদি মজনু ভাইকে কিছু না বলে থাকে, তবে সে জানল কী করে? মজনু ভাই কী আমাদের কখনো একসাথে দেখেছে?

বাইরে শোরগোলের আওয়াজ পেয়ে আমি বের হলাম।

দেখি আব্বু ড্রয়িংরুমের সেন্টার টেবিল লাথি মেরে উল্টে ফেলে দিয়ে গজগজ করতে করতে বলছেন, বাইরে বের হতে পারছি না। পুরো মহল্লা জুড়ে শুধু মৌসুমীর নামে ফিসফিস চলছে। এই বাড়ির কি কোন মানসম্মান নেই নাকী?

আমি সেখান থেকে চলে এলাম। মায়ের ঘরের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় শুনতে পেলাম, মা বলছেন, মানসম্মান অনেক আগেই জলাঞ্জলি গেছে। শুধু তখন কেউ জানতো না। আর আজ জানাজানি হয়েছে।

কেন মা এ কথা বললেন, কী বললেন কিছুই বুঝতে পারলাম না।
আব্বু একটু ঠান্ডা হয়ে নিজের ঘরে বসার পরে আমি আব্বুর কাছে গেলাম।

ভয়ে ভয়ে বলেই ফেললাম, বাবা তুমি মজনু ভাইকে বাসা থেকে তাড়িয়ে দাও।

বাবা চোখ গরম করে তাকালেন।

এরপর বাজখাঁই কণ্ঠে বললেন, বললেই কী তাড়ানো যাবে? তোমার বোন যে বলে যাচ্ছে মজনু ছাড়া সে বাঁচবে না? এখন কি আমার মেয়েকেও তাড়িয়ে দেব? আর তোমাদের মা তো তাদের থাকতে দিয়েছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন বাবা? মায়ের ওপরে তুমি কথা কেন বল না?

বাবা কেমন চমকে আমার দিকে তাকালেন!

– কী এমন হয়েছিল বাবা? কেন সেদিনের পর থেকে তোমরা কথা বল না?

বাবা কিছু বললেন না।

একটুপরে বললেন, ঘরে যা।

ঘরে যাওয়ার মুখে মজনু ভাইয়ের সামনাসামনি হয়ে গেলাম।

সে আমাকে বলল, কী গো শালিকা! এক কাপ চা খাওয়াবে?
আমি তেজের সঙ্গে বললাম, পারব না।
আমি চলে যেতে নিলে সে আবার বলল, আরে শোন, শোন। আমার কবিতার বই বের হবে। তার প্রথম কবিতাটা শোন।
আমি বললাম, আপনার বস্তাপঁচা কবিতা আপনিই শুনুন।

আমি চলে আসতে আসতে মজনু ভাই কবিতা আবৃত্তি করতে থাকে,

আমার শালিকা
একজন বালিকা,
আমার শালিকা মধু
তার বোন আমার বধূ।

এত অসহ্য লাগল, আমার ইচ্ছে করল নিজের চুল নিজেই ছিঁড়ে ফেলি।

এমন সময় মানিক মন খারাপ করে মাথা নিচু করে আমার সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে কিছু হয়েছে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, মানিক দাঁড়া! কিছু হয়েছে?
সে মাথা নেড়ে বলল, কিছু না।
– চোখমুখ এরকম লাগছে কেন?
– আচ্ছা আপু! আমি কি খুব পঁচা?
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, এটা আবার কী রকম কথা!মানিক মন খারাপ করে বলে, মা তাহলে আমার সাথে এরকম খ্যাচম্যাচ করে কেন?

আমি কোন কথা বলতে পারলাম না। ব্যাপারটা আমি নিজেও লক্ষ করেছি। মা আমাকে আর আপুকে যেভাবে আগলে রাখেন, আদর করেন, মানিককে সেভাবে করেন না। মায়ের ভাব দেখে মনে হয়, মানিকের প্রতি উনি শুধুমাত্র তার দায়িত্বটুকু পালন করছেন। কখনো আবার তাও নয়!

মানিক আমার হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে, আপু!
আমি জোর করে হেসে বলি, আরে! কিছু না। মৌ আপু কে নিয়ে টেনশন করছেন তো, তাই বোধহয়।
মানিক ধীরে ধীরে বলে, না রে আপু। ইদানিং নয়, অনেক আগে থেকেই মা এরকম করেন।

বলে সে দ্রুত হেঁটে চলে গেল।

আমি সবকিছু ভেবে ভেবে কোন কূলকিনারা পেলাম না। কিছুক্ষণ পর বিরক্ত হয়ে একটু বাইরে বের হলাম। ভেবেছিলাম মোবাইলে টাকা ভরে বাড়ি যাব। টাকা ভরতে দোকানে গিয়েছি। আমি একদিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম!

একটা কোণায় প্লাবন, রাহাত আর মজনু ভাই একসঙ্গে দাঁড়িয়ে খুব হাসাহাসি করে কথা বলছে।

[চলবে]