হক নিবাস পর্ব-০৪

0
220

#গল্প
#হক_নিবাস
#পর্ব_৪
-শাতিল রাফিয়া

আমি বিস্ফারিত চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে আছি! দোকানদার আমাকে না ডাকলে আমি হয়তো ওইদিকে রওনা দিতাম। দোকানদার মোবাইল নাম্বার আর টাকা দেওয়ার জন্য তাগাদা দিলেন। আমি ব্যাগ খুলে টাকা বের করে দিলাম। এরপর আবার ওদিকে তাকিয়ে দেখি ওরা নেই! কোথায় চলে গেল? ইশশ! আর একটু হলেই আমি হাতেনাতে ধরতে পারতাম!
ওরা একসাথে হাসাহাসি করছিল! এর মানে কী? রাহাতকে বাদ দিলেও প্লাবনের সঙ্গে মজনুর কী সম্পর্ক? আমার মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে চিন্তায়। আচ্ছা আমি কি একটু বেশি-ই ভাবছি? একটার পর আরেকটা গিঁট্টু লাগছে। সেগুলো ছাড়ছে না, বরং আরো শক্তপোক্ত হচ্ছে!

‘মধু’, সমুদ্র ভাইয়ার ডাকে আমি চমকে তাকালাম!

ভাইয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে তোমার? এরকম ফ্যাকাশে কেন লাগছে?

ভাইয়াকে সবকিছু খুলে বলব কী না বুঝতে পারছি না। কিন্তু আমি কিছু করতে চাইলে বা কোন খবর নিতে চাইলে একা করতে পারব না। আমার একজনের সাহায্য লাগবে। এই মুহূর্তে সমুদ্র ভাইয়ার চেয়ে ভালো সাহায্য কেউ করতে পারবে না।

আমি ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জবাব দিলাম, আমি একটা গোলকধাঁধায় আটকে গেছি সমুদ্র ভাইয়া।
চোখ কুঁচকে তাকিয়ে ভাইয়া জিজ্ঞেস করে, কী গোলকধাঁধা?
আমি প্রশ্ন করলাম, বসে বলি?
– কোথায় বসবে? চলো, ওই কাছের ক্যাফেতে গিয়ে বসি।

ক্যাফেতে বসার পর সমুদ্র ভাইয়া দু’টো কফি অর্ডার করল।

আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এবার বলো।

আমি সব খুলে বললাম। তবে আমি যে রাহাতের সাথে প্রেম করছিলাম, সেই সংবাদটা আর দিলাম না। সমুদ্র ভাইয়াকে অবশ্য আমার মত এত বিচলিত হতে দেখলাম না।

কপালে চিন্তার রেখা টেনে ভাইয়া শুধু বলল, প্লাবনের ব্যাপারটা কনফিউজিং!
আমি জিজ্ঞেস করলাম, আর রাহাতের ব্যাপারটা?
– রাহাতকে তো আমি সেভাবে চিনি না, মাধুরী। এমনি এই পাড়ায়, রাস্তায় দাঁড়িয়ে দুই একবার কুশল বিনিময় হয়েছে। সে যেরকমই হোক, তা দিয়ে তোমার কী?

সমুদ্র ভাইয়াকে রাহাতের ব্যাপারটা বলে দেব কী না ভাবছি! বললেও আমি সেদিনের ঘটনা সবটা বলতে পারব না।

সমুদ্র ভাইয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আমি বুঝতেই পারছি না, মৌ আমাকে আমার কোন পাপের শাস্তি দিল!
এরপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি ঠিক বলেছিলে মধু, মৌসুমীকে আমি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করেছি। ওকে দেখে আসলেই মনে হচ্ছে না, ও ভালো আছে! মজনুকে বিয়ে করে কি ভালো থাকা যায়?
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়ে বললাম, কিন্তু কেন যে আপু এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিল!

সমুদ্র ভাইয়া চুপ করে বসে রইল। ভাইয়াকে দেখে বোঝা যাচ্ছে তার ওপর দিয়ে অনেক ঝড়ঝাপটা বয়ে গেছে। তার হৃদয় ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।
তার ফোনটা বেজে ওঠে।

ভাইয়া ফোন তুলে বলল, হ্যাঁ আম্মু। আমি ‘ক্যাফে গ্লোরিয়াস’ এ আছি মধুর সঙ্গে। আচ্ছা আসছি।
ফোন রেখে ভাইয়া বলল, আম্মু তোমাকে নিয়ে আমাদের বাসায় যেতে বলেছে।
– এখন?
– হ্যাঁ। মামা বকবে?
– নাহ! তোমাদের বাসায় গেছি শুনলে কিছু বলবে না।
– চিন্তা করো না। আমি নামিয়ে দেব আবার।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, আজকাল বাসায় একটুও শান্তি লাগে না, আমি হঠাৎই ডুকরে কেঁদে উঠলাম।

সমুদ্র ভাইয়া অপ্রস্তুত হয়ে গেল।

এরপর আলতো করে আমার হাতটা ধরে বলল, কেঁদো না মধু। আমি নিজেও খুব বিপর্যস্ত। আমি জানি না তোমাকে কীভাবে সান্ত্বনা দেব!

সমুদ্র ভাইয়ার সঙ্গে ফুপুর বাসার দিকে রওনা দিলাম।

ভাইয়া জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা মধু, নানী কিছুই বলেননি? মৌসুমী যে এরকম করল?

আমি এবার নিজেই চমকে উঠলাম! আসলেই তো! দাদী তো কিছুই বললেন না এই ব্যাপারে। যদিও উনি বলার মতো অবস্থায় নেই, তবুও কোন ইশারা-ইঙ্গিতও করলেন না? কেন?

সমুদ্র ভাইয়া ফের জিজ্ঞেস করল, খবর পায়নি নাকী?
আমি অনিশ্চিতের মত মাথা নেড়ে বললাম, পাওয়ার তো কথা!
***

আমি দাদীর পায়ের কাছে বসে আছি। দাদীর চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে। আমি অনেক বড় একটা অন্যায় করেছি। কাউকে না জানিয়ে পাড়ার এক বখাটে ছেলে মজনুকে বিয়ে করে ফেলেছি। সবাইকে বলে বেড়াচ্ছি আমি কাজটা ইচ্ছে করে, ভালোবেসে করেছি। কিন্তু না। আসল কারণটা শুধু আমি আর দাদী জানি। মজনু আমাকে ব্ল্যাকমেইল করেছিল।

মজনুর চরিত্র ভালো না। সে রাস্তাঘাটে পথিমধ্যে আমাকে সহ আরো অনেক মেয়েকে উত্ত্যক্ত করতো। আমি আর আমার বোন মধুও ছিলাম সেই তালিকায়। সমুদ্রকে ব্যাপারটা বলব, বলব করেও বলা হয়নি!

একদিনের ঘটনা…

মধুর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা চলছে। আমি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করি। আমি ক্লাসে যাচ্ছিলাম, মজনু হঠাৎই আমাকে দেখে শিষ বাজানো শুরু করল।
আমি পাত্তা না দিয়ে হাঁটতে লাগলাম।

এরপর সে নিজের স্বরচিত কবিতা বলতে লাগলো,

“মৌসুমী নাম তোমার,
ঘুম কেড়েছ আমার,
সুমী বাদ দিলে মৌ,
তুমি কি হবে আমার বউ?”

আমার মেজাজটা এত খারাপ হল যে বলার মত না। সরাসরি মজনুর সামনে গিয়ে তার কলার চেপে ধরলাম।
আমি এতটা সাহস দেখাব, সেটা মজনু কল্পনাও করেনি! সে হতভম্ব হয়ে গেল!

আমি দাঁতে দাঁত ঘষে বললাম, তোর মতো কাকের বউ আমি হব না, অসভ্য, বেয়াদব। আর একবার এইসব বললে জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলব!

এই কথাটা বলেই আমি মজনুর রাগ উঠিয়ে দিয়েছিলাম। একটা প্রতিশোধের নেশা তার মাথায় চেপে বসেছিল। সবার সামনে তাকে অপমান করেছি, সেই অপমানের জবাব সে দেবে না, তাই কি হয় নাকি?
মজনু সময় নিয়েছে।

একদিন রাতে সে আমার মোবাইলে এমন কিছু ছবি আর ভিডিয়ো পাঠিয়েছিল, যে আমি আঁতকে উঠেছিলাম! সেই সাথে থ্রেট দিয়েছিল, ওকে বিয়ে করে আমার বাসায় নিয়ে না উঠলে ও আমাদের পরিবারকে দেখে নেবে।
আমার উপায় ছিল না। কোন উপায় ছিল না। আমার মোবাইলের ছবি আর ভিডিয়োর সঙ্গে এই পুরো পরিবার জড়িয়ে আছে।
এই ছবিগুলো দেখার পর, আমার কাছে আরেক রহস্য উন্মোচিত হয়েছিল। দাদীর একটা মিথ্যে কথা। একটা মিথ্যে কাহিনী বানিয়ে দাদী দিনের পর দিন কীভাবে আমার নজরে আমার মাকে ছোট করে এসেছেন, সেই কিচ্ছাও আমি জেনে গেছি। দাদীকে সেই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে এসেই আমি দাদীকে সব খুলে বলেছিলাম। দাদী নিজের অপরাধ স্বীকার করেছেন।কিন্তু এখন মুখ খুললেই ঝড় নেমে আসবে এই পরিবারের ওপর! সামনে কী হবে, আমি জানি না। দাদীও জানেন না। তাই কেঁদে যাচ্ছেন। দাদীর কান্না দেখতে অসহ্য লাগছে। উনি চাইলে অনেক আগেই অনেক কিছু ঠিক করে করতে পারতেন। সবকিছু তাহলে বদলে যেত। কিন্তু উনি সেটা করেননি।

অনেক কিছু জেনে গেলেও এই সবকিছুর মূলে কে, কেন-ই বা সে আমাদের পরিবারকে টার্গেট করেছে আমি বুঝতে পারছি না।
মজনুর মত ফালতু একটা মানুষের এত সাহস নেই যে আমার সঙ্গে প্রতিশোধ নেয়ার নেশায় এতকিছু একা একা যোগাড় করবে। কেউ ওকে ইন্ধন যুগিয়েছে। কে সে? একজনকে আমি মনে মনে সন্দেহ করেছি। আমার সন্দেহ সত্যি হলে অনেকেরই পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাবে!

অনেক মানুষ আমার ওপর রেগে আছে। অনেক মানুষ কী! সবাই রেগে আছে। আব্বু, আম্মু, মধু, মানিক, প্লাবন, আর আমার সমুদ্র। সমুদ্রকে আমি সমুদ্র পরিমাণই ভালোবেসেছি। কিন্তু সে আমাকে হয়তো এখন ভুল বুঝছে। নাহ! তাকে দোষ দিচ্ছি না। আমি যা করেছি, তার পরে কী আর আমাকে বিশ্বাস করা যায়? তার ওপর তার মুখের ওপরে বলেছি, আমি তোমার সাথে শুধুমাত্র সময় কাটাচ্ছিলাম!
আমি সব হারিয়েছি, সব। এর শেষ কোথায় আমি জানি না।
***

ফুপু আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরলেন। আমাদের দুই বোনকে ফুপু অনেক ভালোবাসেন। ফুপু আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলেন। কেন মৌ আপু মস্ত বড়ো এক ভুল করল! ফুপুর কাছে নাকী আপুর জন্য অনেক ভালো পাত্রের সন্ধান ছিল।

আমিও কেঁদে দিলাম।

ফুপু আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু দিয়ে বললেন, কাঁদিস না মা। সব ঠিক হয়ে যাবে। তোর ইন্টারও শেষ। আমি এবার তোর বাবার সাথে তোর আর সমুদ্রের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলব। আমার আর তোর ফুপার অনেকদিনের ইচ্ছে!

ফুপুর ইচ্ছের কথা শুনে আমি আর সমুদ্র ভাই ভয়ানক ভাবে চমকে উঠলাম!

[চলবে]