হক নিবাস পর্ব-০৫

0
183

#গল্প
#হক_নিবাস
#পর্ব_৫
-শাতিল রাফিয়া

আমি চুপচাপ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। সন্ধ্যা নেমেছে চারিদিকে। আজানের শব্দ ভেসে আসছে। সেই সাথে আশেপাশের প্রতিটি বাসায় বাতিগুলো জ্বলে উঠছে। আমি আমার জায়গা থেকে নড়লাম না, ঘরের লাইটও জ্বালালাম না। আমার পুরো জীবনটাই তো নিকষ কালো ভূতুড়ে অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। খামোখা ঘর আলোকিত করে কোন লাভ আছে?

বাবাকে দেখতে পেলাম চাচাকে সঙ্গে নিয়ে মসজিদে নামাজ পড়তে যাচ্ছেন। আমি চাচাকে দেখে খুব অবাক হই! চাচা এমনভাবে থাকেন, যেন কোন কিছুতেই তার কিছু যায় আসে না। বাবা যেটা বলেন, সেটা চাচা নিঃশব্দে মেনে নেন। আমার চাচীও ঠিক তেমন। মা যখন সংসারের দায়িত্ব সব ছেড়ে দিয়েছিলেন, নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন, চাচী চাইলেই পারতেন দাদীর মন জয় করে সব তার হাতের মুঠোয় করে ফেলতে। কিন্তু চাচী এসব কিছুই করেননি।
বাবা মেইন গেট খুলতেই মানিকের সাথে দেখা হয়ে গেল। মানিকের কাঁচুমাচু মুখ আর বাবার উত্তপ্ত গলায় বুঝতে পারলাম মানিক এত দেরি করে ফিরেছে বলে বাবা তাকে বকে দিচ্ছেন। চাচা বাবাকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করছেন। বাবা ঘাড় ধরে মানিককে মসজিদে নামাজ পড়তে নিয়ে গেলেন।
আমার ঘরের বারান্দা থেকে সব পরিষ্কার দেখা যায়। আমি অনেক শখ করে এই ঘরটা নিয়েছিলাম আকাশ দেখব বলে। আজকাল আর আকাশ দেখতে ভালো লাগে না। কিছুই ভালো লাগে না।
হঠাৎই মনে হল, আচ্ছা বাবা যে এখন প্রতি ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন, দুই হাতে বিলি করেন, তার কী আগের পাপ মওকুফ হয়ে যাবে? বাবা কি একটুও অনুতপ্ত তার কৃতকর্মের জন্য? আর দাদী? দাদী কি এখন বুঝতে পারেন? দিনের পর দিন অন্য মানুষের ঘাড়ে অপকর্মের দোষ চাপিয়ে দাদী কি পাপ করেননি? দাদী কি এখন তার পাপের শাস্তিই পাচ্ছেন? কী জানি!
মজনু বাড়ি নেই। ভালো হয়েছে। সে নেই দেখে ভালো লাগছে। সে থাকলেই দুনিয়ার যন্ত্রণা করে।
না, সে আজ পর্যন্ত আমার গায়ে হাত তোলেনি, আমাকে শারিরীক নির্যাতন করেনি। এমনকি আমার ওপর জোরও করেনি। বিয়ের পর এই বিষয়টি নিয়ে আমি প্রচন্ড দুঃশ্চিন্তায় ছিলাম। আমি আমাদের বিয়ের রাতে একসাথে ঘুমোবার সময় দু’জনের মাঝখানে একটা বড় কোলবালিশ রেখে দিয়েছিলাম। মজনু সবই দেখেছে। সে নিজেই লাইট বন্ধ করে, পাশ ফিরে ঘুমিয়ে গিয়েছিল। সেই রাত আমি আমার দুই চোখের পাতা এক করিনি। করব কী করে? এতসব কিছুর পরেও কী তা সম্ভব?
মজনুর যন্ত্রণাগুলো অন্যরকম।

বাসায় বসে থাকলে একটু পর পর সে বলবে, বউ শোন। একটা কবিতা লিখেছি, শুনে যাও।

আমি নিশ্চুপ থাকি।

মজনু নিজেই উৎসাহের সাথে বলে, জানো তো, আমার কবিতার বই বের হবে কিন্তু!

এই কথা আমি প্রতিদিন অন্তত বিশবার করে শুনি। কে যে তার এই অগাবগা, ছাইপাঁশ কবিতা প্রকাশ করবে, আমার মাথায় আসে না। আর কেউ এমনি এমনি তার এই ফালতু কবিতার বই ছাপিয়ে দেবে, এতই কী সোজা? আমি জানি না কী করে সে কোন প্রকাশককে রাজি করিয়েছে! আদৌ করিয়েছে কী না, এমনি হম্বিতম্বি করে যাচ্ছে, সেটাও পরিষ্কার নয়।

মজনু পাত্তা না পেয়ে বলে, বউ আমাকে দাম দেয় না। কী আর করা! আমার মর্ম কেউ বুঝে না। বুঝবে, যেইদিন আমার বই প্রকাশিত হবে।
আমি এবারে মুখ খুলি, কে ছাপিয়ে দিচ্ছে তোমাকে বই?

মজনুর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

সে বলে, আছে আছে। আচ্ছা এইবার কবিতা শোন,
” নেই আমার বাড়ি
নেই আমার গাড়ি
আমার আছো তুমি
সারাজীবন তোমার সাথে থাকব আমি।”

আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকি? এগুলো কবিতা? এই অখাদ্যকে কবিতা বলে?

আশা নিয়ে মজনু জিজ্ঞেস করে, কেমন হয়েছে?

আমি মুখ ঝামটা দিয়ে বেরিয়ে যাই।

মজনু ঘরে থাকলে এইসব যন্ত্রণা করে। এই উদ্ভট সব কবিতা বানিয়ে শোনায়! বিয়ে করা বউ থাকা সত্ত্বেও কেন তাকে একাকী সময় কাটাতে হয় সেটা নিয়ে আফসোস করে! অসহ্য!

বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম বাবা, চাচা আর মানিক ফিরে এসেছে। ঢোকার সময় তাদের সঙ্গে মজনুও জুটে গেল।
মজনুকে দেখে বাবা চোখ কুঁচকে ফেললেন। তার মুখ থমথমে কঠিন হয়ে গেল! মজনু দেখলাম ফিচলে হাসি ফুটিয়ে হাত কচলাতে লাগল। বাবা হুংকার দেয়ার আগেই চাচা বাবাকে টেনে ভেতরে নিয়ে গেলেন।

মজনু মানিকের গাল টিপে দিয়ে বলল, কী খবর শ্যালক সাব?

মানিক চোখ পাকিয়ে, মুখ বাঁকিয়ে চলে গেল।

মজনু হতাশায় মাথা নেড়ে ভেতরে ঢুকতে গিয়ে ওপরে তাকাল। আমার সাথে তার চোখাচোখি হল। না আমি চোখ নামিয়ে নিলাম, না সে চোখ নামাল। আমার চোখের দিকে সে তাকিয়েই রইল। এই চারিদিক থেকে আসা হলদে বাতির আলোয়, ল্যাম্পপোস্টের আলোয় তার চোখের দৃষ্টি আমার অচেনা লাগল, আমি বুঝতে পারলাম না। মজনু চোখ নামিয়ে নিল। এরপর হেঁটে হেঁটে ভেতরে ঢুকল।

ভেতরে ঢুকে লাইট জ্বালিয়ে জিজ্ঞেস করল, অন্ধকারে কী করো তুমি?

উত্তর দিলাম না। তার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা আমি কখনোই অনুভব করিনি, করি না।

মজনু শান্ত গলায় বলল, ভেতরে আসো বউ। মশা কামড়াবে। তোমাকে মশা নিয়ে একটা কবিতা শোনাই।

তার কবিতা শোনার ভয়ে আমার ভেতরে যাওয়ার যেটুকু ইচ্ছে ছিল সব উবে গেল। মনে হল, বারান্দার দরজা আটকে এখানেই বসে থাকি সারারাত।

হঠাৎই একটা বাইকের শব্দ পেলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেইন গেট আবার খুলে গেল। মধু পুরোটা গেট খুলে দিলে সমুদ্র তার বাইক ঢোকাল। আমি স্থির দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কারণ আমি নিজেও জানি না। কতবার এই বাইকে আমি উঠেছি! সমুদ্রের কাঁধে হাত রেখে পরম নির্ভরতায় দূর-দূরান্তে চলে গিয়েছি দু’জনে।

ভেতরে ঢোকার সময় মধু ইটের সঙ্গে পা বেঁধে হোঁচট খেল। সমুদ্র এসে নায়কের মতো খপ করে তার হাত ধরে ফেলল।

চিন্তিত মুখে কিছু একটা জিজ্ঞেস করল। মধু চোখমুখ বিকৃত করে জবাব দিল। এরপর সমুদ্র মধুর হাত ধরেই ভেতরে ঢুকল। ভেতরে ঢোকার সময় তার সাথেও আমার চোখাচোখি হল। কিন্তু সমুদ্রের দৃষ্টির সামনে আমি লজ্জায় মিশে গেলাম। এক পলক দেখেই আমি চোখ নামিয়ে নিলাম। তার দিকে চোখ তুলে দ্বিতীয়বার তাকানোর সাহস আমার হল না।
চোখ নামিয়ে চোখটা বন্ধ করতেই দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে।

মজনু এসে আমার কাঁধে হাত দিয়ে বলল, আসো না কেন ভিতরে?

সমুদ্র আর মধুকে দেখে সে দাঁত কেলিয়ে বলল, তোমার বোনের জীবনে আসলেই মধুমাস আসতেছে।

চোখটা খুলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মজনুর দিকে তাকাতে সে বলল, সমুদ্রের সঙ্গে ওর বিয়ে।

আমি এতটাই অবাক হলাম যে কী বলব বুঝতেই পারলাম না! হা করে আমি মজনুর দিকে তাকিয়ে রইলাম।

মজনু পাত্তা না দিয়ে ফের জিজ্ঞেস করে, প্রাক্তন প্রেমিকের সঙ্গে বোনের বিয়ে! কেমন সিনেম্যাটিক না ব্যাপারটা?

আমার উত্তর দেওয়ার কোনো ভাষা নেই।

মজনু অবশ্য উত্তর চাইল না আর!

বলল, মশা নিয়ে কবিতাটা শোন,
“রক্তপিপাসু ডাকু
তোমাকে করব আমি কুপোকাত,
তুমি গালে বসলেই
মারব চড় ঠাশ ঠাশ ঠাশ!”

কেমন হয়েছে কবিতাটা?

আমার মাথায় আর কিচ্ছু ঢুকছে না। কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে মাথাটা!

আমি বারান্দা থেকে ভেতরে ঢুকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমায় কে বলল যে মধু আর সমুদ্রের বিয়ে?
দাঁত কেলিয়ে মজনু বলে, তোমার বাপ আর চাচা যখন মসজিদে যাচ্ছিল, আমিও পিছে ছিলাম। উনারা দেখেনি। তখন তোমার বাপ বলছিল। তোমার ফুপু আর ফুপার নাকী অনেক শখ! তোমার ফুপু নাকী ফোন করে তোমার বাপকে বলেছে। আমি যেহেতু পিছেই ছিলাম শুনে ফেলেছি।
আমি নিষ্প্রাণ কণ্ঠে বললাম, ওহ!
মজনু জিজ্ঞেস করে, তোমার খারাপ লাগছে না মৌসুমী?

আমি নিষ্পলক চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

– লাগছে না?

আমি এবার চোখের জল লুকোতে অন্যদিকে তাকালাম। যন্ত্র তো আর নই! খারাপ কেন লাগবে না?

মজনু নিজেই বলে, আমার কিন্তু খারাপ লাগছে।
এরপর সে খুব ধীরে ধীরে বলে, তোমার জন্য!

আমি ঝট করে মজনুর দিকে ফিরে তাকালাম।

ম্লান হেসে মজনু বলল, মাঝেমধ্যে মনে হয় ভালো হয়ে যাই!
আমি এবারে মুখ খুললাম, কী বলতে চাইছ?
– কিছু বলতে চাইছি না। মশার কবিতাটা কেমন হয়েছে? ভেবেছি মশারি নিয়ে একটা কবিতা লিখব। এরপর দু’টো একসাথে করে…

আমি মশা আর মশারি সংক্রান্ত কবিতায় আগ্রহ পেলাম না। মজনুর কথা শেষ হওয়ার আগেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলাম।
***

আমার ঘরে আমি, সমুদ্র ভাইয়া, রেহনুমা আর মানিক বসে আছি। রেহনুমা আর মানিককে নিয়ে বসেছি কারণ তাদের সাহায্য আমাদের দরকার। আপু কেন হুট করে মজনুকে বিয়ে করেছে, আর কেনই বা রাহাত, প্লাবন আর মজনু ভাই একসঙ্গে হাসাহাসি করছিল, সেই তথ্য খুঁজে বের করতে হবে। আর এর মধ্যে ফুপু আর বাবা আবার আমার আর সমুদ্র ভাইয়ার বিয়ে নিয়ে আলোচনা শুরু করতে চাইছেন। যেটাতে আমার আর সমুদ্র ভাইয়ার কারোরই কোন আগ্রহ নেই। তবে আমাদের মতামত খুব একটা ধোপে টিকবে বলে মনে হচ্ছে না!

আমি সবার আগে বললাম, রেহনুমা তুই আপু আর মজনু ভাইকে চোখে চোখে রাখতে পারবি না?
ঠোঁট বাঁকিয়ে, চোখ উল্টে সে জবাব দেয়, মনে হয় না! চোখে চোখে আবার রাখে কীভাবে?
আমি চোখ গরম করে বললাম, দেব একটা থাবড়া!
সমুদ্র ভাইয়া নরম গলায় বলল, আহ! মধু থাম!
এরপর সে রেহনুমার দিকে তাকিয়ে বলে, রেনু, চোখে চোখে রাখবে বলতে মধু বোঝাতে চেয়েছে ওদের দু’জনের মধ্যে সম্পর্ক কেমন সেটা বুঝতে।
– সেটা আমি কীভাবে বুঝব?
সমুদ্র ভাইয়া আবার মাথা নেড়ে বলে, যেমন ধরো ওরা কি নিজেদের মধ্যে অনেক বেশি গল্প করে, নাকী নিজেদের মতো থাকে, চুপচাপ থাকে…
আমি আবার রেগে উঠে বললাম, তুই সারাদিন এর-ওর ঘরে আড়ি পেতে থাকিস, এর কথা শুনে তাকে গিয়ে বলে বেড়াস, আর এটা করতে পারবি না?
আমার কঠিন দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রেহনুমা বলল, আ- আচ্ছা… আমি পারব।

এরপর মানিকের দিকে তাকিয়ে কিছু বলার আগেই মানিক বলে, আমি জানি আমাকে কী করতে হবে।

বলেই সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

আমি রাগী দৃষ্টিতে ওর যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে বললাম, এটা একটা কাজ করল? আজব তো!
সমুদ্র ভাইয়া বলে, বাদ দাও মধু। ছোট মানুষ। আচ্ছা, আমি আজ উঠি। তুমি সময় সুযোগ করে মামার সঙ্গে কথা বল। মামা তো কখনো মামীর কথা ফেলেন না। মামীকে বলে দেখ। আমিয়ো মাকে বলব।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, ঠিক আছে।

সমুদ্র ভাইয়া যাওয়ার আগেই মানিকে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, কোথায় যাচ্ছ? ভাইয়া এটা দেখ।

মানিকের হাতে আপুর মোবাইল ফোন।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপুর ফোন? কী দেখব এতে?
– কোন ক্লু থাকতে পারে না?
সমুদ্র ভাইয়া উত্তর দিল, কী ক্লু থাকবে! আর পারমিশন ছাড়া কারো ফোন চেক করা উচিৎ নয়। তুমি কি মৌসুমীকে বলে এনেছ?
– না!
– তাহলে ফিরিয়ে দিয়ে এসো।
আমি বাঁধা দিয়ে বললাম, না! ও ঠিকই বলেছে। দেখি দে ফোনটা!
সমুদ্র ভাইয়া বিরক্ত হয়ে বলল, এটা বাড়াবাড়ি হচ্ছে।
– অনেক কিছুই বাড়াবাড়ি হয়েছে ভাইয়া।

আপুর ফোনের পাসওয়ার্ড আমি আগেই জানতাম। খুলে সরাসরি সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢুকে গেলাম। মজনুর সাথে আপুর কথাবার্তা পড়ার জন্য কনভার্সেশনটা খুলতেই কিছু ছবি আমার সামনে চলে আসে। আমি ছবিগুলো দেখে আঁতকে উঠলাম!

[চলবে]