হক নিবাস পর্ব-০৬

0
176

#গল্প
#হক_নিবাস
#পর্ব_৬
-শাতিল রাফিয়া

আমি ছবিগুলো দেখে থরথর করে কাঁপতে লাগলাম! আমার এই কাঁপুনি দেখে সমুদ্র ভাইয়া হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এসে আমায় ধরল।

সে জিজ্ঞেস করে, মাধুরী কী হয়েছে তোমার?

আমি উত্তর দেওয়ার মতো কোন অবস্থাতেই নেই। আমার চোখ ফেটে কান্না আসছে। আমি মোটামুটি বুঝে গেলাম আপু কেন ওই ফালতু লোকটাকে বিয়ে করেছে। সেই সাথে এক তীব্র আশংকায় আমার মন ছেয়ে গেল!
আমার এই অবস্থা দেখে মানিক আর রেহনুমাও হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে! কেউ কিছু বোঝার আগেই সমুদ্র ভাইয়া আমার হাত থেকে মোবাইলটা নিল। ছবিগুলো দেখে সে কোন কথা বলল না! মোবাইলে কিছু একটা করে সে আবার মোবাইলটা লক করে মানিকের হাতে দিয়ে দিল।

মানিক কিছু বলার আগেই থমথমে মুখে ভাইয়া বলে, ফোনটা গিয়ে মৌসুমীকে ফিরিয়ে দিয়ে এসো, মানিক।
রেহনুমা জিজ্ঞেস করে, কিন্তু কিন্তু কী আছে এটাতে? এ…
ভাইয়া কঠিন কণ্ঠে বলে, মানিক, আমি তোমাকে কিছু বলেছি। আর কোনদিন না বলে এভাবে কারো ফোন নেবে না। যাও।

মানিক কী করবে বুঝতে না পেরে ফোন হাতে বেরিয়ে গেল।

ভাইয়া রেহনুমাকে বলে, তুমিও যাও। মধুর সঙ্গে আমার কিছু জরুরি কথা আছে।

সবাই চলে গেলে ভাইয়া দরজা আটকে আমার পাশে এসে বসে। আমি দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে হুহু করে কেঁদেই চলেছি।

ভাইয়া আমার হাত সরিয়ে জিজ্ঞেস করে, কবে থেকে শুরু হয়েছে এসব মধু?

আমি কোন জবাব দিলাম না।

ভাইয়া শান্ত স্বরে আবার বলল, রাহাতের সাথে ক’দিন ধরে তোমার সম্পর্ক? সব বলো আমাকে।

কান্নার দমকে আমি কথাই বলতে পারছি না।

সমুদ্র ভাইয়া প্রশ্ন করে, আর কেন-ই বা সেই সম্পর্ক এত দূর গড়িয়েছে?

আমি ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললাম, ভাইয়া, বিশ্বাস করো, আমার সাথে রাহাতের কোন শারিরীক সম্পর্ক নেই!
– তাহলে ছবিগুলো কীভাবে এল মধু?
– তুমি আমায় বিশ্বাস করছ না?
– করেছি। তবুও জানতে চাইছি।

আমি সেদিনের সমস্ত ঘটনা খুলে বললাম।

এরপর বললাম, রাহাত আমার সাথে জোর করেছিল। কিন্তু কিছু করেনি। আর পরে অনেকবার ক্ষমাও চেয়েছিল!
চিন্তিত মুখে সমুদ্র ভাইয়া বলে, তার মানে ছবিগুলো তোলার জন্যই রাহাত তোমার সাথে এরকম করেছে। প্রতিটা ছবিতে তোমার চেহারা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু রাহাতের চেহারা অস্পষ্ট।
আমি ডুকরে কেঁদে উঠে বললাম, আর এসব কাজ রাহাতকে দিয়ে মজনু করিয়েছে। যাতে আপুকে ব্ল্যাকমেইল করতে পারে, যেন আপু মজনুকে যে থাপ্পড় মেরেছিল সেই অপমানের প্রতিশোধ নিতে পারে!

সমুদ্র ভাইয়া চুপ করে থম মেরে বসে থাকে। আর আমি আত্মদহনে ছারখার হয়ে যাই! আমার জন্য আমার বোনের জীবনটা ধ্বংস হয়ে গেল! রাহাতকে বিশ্বাস করে আমি আমার বোনের জীবনটা বিষিয়ে দিলাম, ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিলাম!

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সমুদ্র ভাইয়া জিজ্ঞেস করে, কিন্তু মধু! তাহলে লেখাগুলো কীসের?

আমি অবাক হয়ে তাকালাম!

জিজ্ঞেস করলাম, কোন লেখা?
– হাতে কিছু লেখা কয়েকটা কাগজের ছবি আছে। তখন তাড়াহুড়োয় পড়িনি। আর আমি চাইনি এসব বিষয় মানিক আর রেনু জানুক।
আমি বললাম, আমি এরকম কোন কিছু খেয়াল করিনি।
বিড়বিড় করে ভাইয়া বলে, করার কথাও না।
এরপর আমাকে আবার বলে, তোমার মোবাইলটা দাও মধু।

আমি কথা না বাড়িয়ে আনলক করে মোবাইলটা ভাইয়ার হাতে তুলে দিলাম।

ভাইয়া নিজেই বলল, তখন মৌসুমীর ফোনে হাতে লেখা কাগজগুলো দেখে ওর ফোন থেকে কাগজগুলোর ছবি তোমার মোবাইলে ট্রান্সফার করে দিয়েছিলাম।
আমি বললাম, আপু তো বুঝে যাবে।
মাথা নেড়ে ভাইয়া উত্তর দিল, না। ‘রিমুভ ফর ইউ’ তে গিয়ে ডিলিট করে দিয়েছি।

ভাইয়া আমার মোবাইল থেকে ছবিগুলো দেখে। আমাকেও দেখাল। মনে হচ্ছে বেশ ক’বছর আগে কোন ডায়েরির পাতায় লেখা কিছু। হাতের লেখাটা খুব একটা সুন্দর নয়। পাতাগুলো হলদে হয়ে আছে। কে লিখেছে সেটা জানি না। ভাইয়া পড়তে লাগল। যতই পড়ল, তার চোখমুখ কুঁচকে ওঠে!

আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে ভাইয়া? কী লেখা আছে এতে?

ভাইয়া হাত তুলে আমাকে থামিয়ে দিল।

ভাইয়ার পড়া শেষ হলে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি নিজেই চমকে উঠলাম! ভাইয়ার এরকম কঠিন মুখ, রাগী চাহুনি আমি আগে কখনোই দেখিনি।

আমি ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করলাম, ভ.. ভাইয়া… কী হ.. হল?

কথা না বাড়িয়ে ভাইয়া আমার মোবাইল ফিরিয়ে দিল।

এবার আমি দেখলাম। পেইজগুলোতে এভাবে লেখাঃ

“আমার আর শফিক সাহেবের সম্পর্ক অনেক ভালো। উনি আমার অনেক যত্ন নেন। আমার সব সুবিধা অসুবিধার দিকে নজর রাখেন। যেটা বাবা রাখেন না।”

এরপর আরেক পৃষ্ঠায় লেখাঃ

“আজ কী একটা কান্ড হল! বিয়ের আগে এটা হওয়া একদম ঠিক হয়নি। একদম না।”

এরপরে একই পাতায় তিনমাস পরের নতুন তারিখ দিয়ে লেখাঃ

“আমার গর্ভে শফিক সাহেবের সন্তান। উনি এখনো জানেন না। আজ আমি তাকে সব খুলে বলব। আমার দৃঢ় বিশ্বাস উনি সব মেনে নিবেন। আমরা বিয়ে করব। যদিও উনি বিবাহিত, কিন্তু তবুও আমার সন্তানকে তো বাবা-মায়ের পরিচয় দিতেই হবে।”

পরের পাতায় লেখাঃ

“আমি বিশ্বাসও করতে পারি না শফিক সাহেব এরকম করলেন! উনি আমাকে বিয়ে করবেন না! এমনকি আমাকে বলেছেন বাচ্চাটা না নিতে! আমি এখন কী করব? আমার কাছে তো কোন প্রমাণ নেই! বাবা জানলে আমাকে মেরেই ফেলবে। আমি কী করে একটা নিষ্পাপ প্রাণ নষ্ট করব! সেই অধিকার তো আমার নেই! আমি আমার বাচ্চাকে এই পৃথিবীর আলো দেখাব। সেটা যেভাবেই হোক। আমি আজ শফিক সাহেবের স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলব।”

এরপর নতুন তারিখে লেখাঃ

” সব ঠিক হয়ে যাচ্ছে। শফিক তার ভুল বুঝতে পেরেছে। সে আমাকে আর তার সন্তানকে আপন করে নেবে বলেছে। আজ তার মা-সহ সে এসেছিল। তার মা আমাকে আজ চেন পরিয়ে গেছেন। আমার পরিবারকে সব খুলে বলতে বলেছে। তবে আমার কাছে তারা কিছু সময় চেয়েছেন, তার প্রথম স্ত্রীকে রাজি করানোর জন্য। ভাগ্যিস আগেই আমি তার প্রথম স্ত্রীকে সব বলে দেইনি।

এরপর লেখাঃ

“মানুষ এত খারাপ! নয় মাস গর্ভে রাখার পর, বাবার ত্যাজ্য কন্যা হয়ে, সব অপমান সহ্য করেও শিশুটিকে আমি পৃথিবীর মুখ দেখালাম। আর আজ কী না শফিক সাহেব আর তার মা আমার কাছ থেকে আমার-ই ছেলেকে নিয়ে গেল! করছি, করব, করে করে নয় মাস হয়ে গেল! শফিক সাহেব বিয়ে করে আমাকে স্ত্রীর মর্যাদা দেবেন না, কিন্তু তার ছেলেকে তার ঠিক চাই। আর আমাকে খোকা ভোলানোর মত বিয়ে, সংসার আর ছেলের ভালো ভবিষ্যতের লোভ দেখিয়ে তারা আমায় এভাবে ঠকাল! ছি! আমি এখন কী করব? কী নিয়ে বেঁচে থাকব? কোথায় যাব আর সমাজেই বা এই মুখ কী করে দেখাব? আমার কথা কি কেউ বিশ্বাস করবে? শফিক হক এই এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি! তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুললে কি আমার দিকেই আঙুল উঠবে না? আর আমার প্রমাণ-ই বা কোথায়?”

এই কয়টা পৃষ্ঠার লেখা ছিল। আমি লেখাগুলো পড়ে হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম!

কিছুক্ষণ পর চেঁচিয়ে উঠলাম, তার… তার মানে…
সমুদ্র ভাইয়া আমার মুখ চেপে ধরে বলে, আস্তে মধু। হ্যাঁ, যা ভেবেছ তাই। তারিখগুলো লক্ষ কর। আজ থেকে ষোল বছর আগের। আর মানিকের বয়সও পনের। তার মানে মানিক মামা-মামীর নয়, বরং মামা এবং এই লেখাগুলো যে লিখেছেন তার সন্তান। আর ব্যাপারটা নানীও জানেন। আর আমার এখন মনে হচ্ছে মামীও জানেন। আর সেই জন্যেই মামী গত পনের বছর ধরে মামার সঙ্গে কথা বলেন না!

আমি তীব্র গতিতে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, আমি আজ এর জবাব জানবই। বাবাকে সব খোলাসা করতে হবে। কে এই মহিলা, মানিকের মা কে আর… আর এসবের সঙ্গে আপুর কী সম্পর্ক, মজনুর কী সম্পর্ক…

আমি যেতে নিলেই ভাইয়া আমার হাত টান দিয়ে ধরে আমায় থামাল।

এরপর বলল, পাগলামি করো না মধু! আমরা এখনো কিছুই জানি না!
– সেইটাই তো জানব…
– মধু এমনও হতে পারে এসব কিছু বানানো। কেউ মামাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে!
– তোমার এখনো তাই মনে হয়?
– না। কিন্তু মধু। রাত হয়েছে। এই রাতে চিৎকার-চেঁচামেচি করে লোক জড়ো করো না। আর নানীরও বয়স হয়েছে। নানী অসুস্থ। যা জানার সকালে জানা যাবে। প্লিজ মধু।

আমি চুপ করে বসে রইলাম। আমার ভেতর থেকে সব অনুভূতি যেন চলেই গিয়েছে!
***

সকালবেলা ঘুম ভাঙল মজনুর চিৎকার-চেঁচামেচি, কান্নাকাটি এবং আহাজারিতে! আমি ঘুম ভেঙে ধড়মড় করে উঠে বসে তার দিকে তাকালাম।

মজনু মাটিতে বসে মাথায় হাত দিয়ে বিলাপ করে কাঁদতে কাঁদতে বলছে, আল্লাহ আমি এতিম হয়ে গেলাম গো! আল্লাহ!

আমার দিকে তাকিয়ে সে বলে, বউ! আমার আব্বা-আম্মা মারা গেছে বউ!

[চলবে]