হক নিবাস পর্ব-০৭

0
194

#গল্প
#হক_নিবাস
#পর্ব_৭
-শাতিল রাফিয়া

আমি থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী বললে? কে মারা গেছে?
বুকফাটা আর্তনাদ করে সে বলল, আরে আমার মা-বাবা! তোমার শশুড়-শাশুড়ি।
হতভম্ব হয়ে আমি বললাম, কী বলছ এসব? কী করে?

কাঁদতে কাঁদতে মজনু যেটা বলল, তা হলো, ওর বাবা-মা জমিজমা সংক্রান্ত কিছু কাজে ওর গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফেরার পথে দু’টো বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে। দুইজন বাসচালক-ই নিহত হয়েছেন। অনেক যাত্রী আহত হয়েছেন। দশজন যাত্রী স্পটডেড। তাদের মধ্যে দুইজন হলেন মজনুর বাবা-মা।

সব শুনে আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। পৃথিবীতে মা-বাবার মৃত্যুর কোন সান্ত্বনা হয় না। মজনু আরো কিছুক্ষণ কাঁদল, কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকল। এরপর একটা ব্যাগ বের করে নিজের জামাকাপড় ভরা শুরু করল।

আমি জিজ্ঞেস করলাম না কিছুই। বুঝতেই পেরেছি সে বাসায় যাচ্ছে। তার বাবা-মায়ের মৃতদেহ আনার ব্যবস্থাও করতে হবে।

আমি মজনুর কাঁধে হাত দিয়ে বললাম, তুমি যাও। আমি আমাদের জামাকাপড় গুছিয়ে তোমার বাসায় যাচ্ছি।
মজনু জামাকাপড় গোছাতে গোছাতেই বলল, তোমার যেতে হবে না কোথাও।

মজনুর জন্য খারাপ লাগছে। এমন নয় যে আমি তাকে ভালোবেসে ফেলেছি, অথবা তার প্রতি আমার কোন টান আছে, কোন অনুভূতি আছে! এসব কিছুই নয়। আমি শুধুমাত্র মানবিক কারণে তার সাথে যেতে চেয়েছি। মজনুর আত্মীয়স্বজন সেরকম কেউ নেই। তার চাচাদের সঙ্গে তার বাবার সম্পর্ক সেরকম ভালো নয়। আর তার মায়ের দিকের সেরকম কেউ নেই, থাকলেও তাদের সঙ্গে মজনুদের খাতির নেই।
মাঝেমধ্যেই আমার সঙ্গে গল্প বলার উছিলায় মজনু-ই আমাকে এসব বলেছে।

আমি মজনুর কথার পাত্তা না দিয়ে তাকে জোর করে সরিয়ে নিলাম।

এরপর বললাম, তুমি তাড়াতাড়ি যাও। আমি এদিকে সামলাচ্ছি। আমি সরাসরি তোমাদের বাসায় যাব। আমি চিনি।

মজনু আমার চোখের দিকে তাকায়। সে কী বুঝল আমি জানি না, কিন্তু সে নিজের চোখ মুছতে মুছতে আর কোন তর্ক না করে বেরিয়ে গেল।

আমার বাসায় সবাই জেনেছে মজনুর বাবা-মা মারা গেছেন।

আমি বেরোনোর সময় বাবা কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাচ্ছ তুমি?
আমি একবাক্যে জবাব দিলাম, মজনুদের বাড়ি।
বাবা থমথমে কণ্ঠে বললেন, আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি মৌ! ও গেছে যাক না, তুমি কেন যাচ্ছ?
আমি আরো কঠিন স্বরে উত্তর দিলাম, অবাক তো আমি হচ্ছি বাবা! একজনের বাবা-মা মারা গেছেন, আর আমি যাব না! আর এমন তো নয় যে আমি তাদের চিনি না! সম্পর্কে উনারা আমার শশুড়-শাশুড়ি হন। উনাদের ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে!

মধু কখন বাবার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে লক্ষ করিনি।

পাশ থেকে হঠাৎই মধু ব্যঙ্গ করে বললেন, বিয়ে! তুমি নিজে ওকে স্বামী হিসেবে মেনে নিয়েছ তো? এই বিয়ে তুমি মানো তো?

মধুটারও মনে হয় বিবেক-বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। কেউ কেন বুঝতে পারছে না, আমি কিছুই মেনে নেইনি। আমি শুধুমাত্র নিজের বিবেক, দায়িত্ববোধ আর নিজের মানবিকতা থেকে যাচ্ছি!

আমি জবাব দিলাম, আমি বিয়ে মেনে নিয়েছি কি নেইনি, মজনুর সাথে আমার সম্পর্ক কেমন, সেটা আমি তোমাদের জানাতে বাধ্য নই। আর তোমরাও আমাকে বাঁধা দিতে পারো না।
বাবা আবার কিছু বলার আগেই মা এসে শান্ত গলায় বললেন, মৌসুমী, তুই যা। আমার মেয়েদের আমি মানবিকতা শিখিয়েছি।

বাবা রাগে কাঁপতে লাগলেন, কিন্তু বরাবরের মতোই মায়ের কথার ওপরে আর কিছু বললেন না।

আমি মানিককে ডেকে বললাম, আমাকে একটা রিকশা ঠিক করে দে তো।

রিকশা নিয়ে আমি মজনুদের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

একদিন পর আজ বাদ মাগরিব তার বাবা-মায়ের মৃতদেহ দাফন করা হয়েছে। মজনু কোন কথাই বলছে না। কান্নাকাটি করতে করতে তার গলা ভেঙে গেছে। ভাঙা গলায় সে আমাকে শুধু একটা প্রশ্নই বারবার করে যাচ্ছে, “বউ, আমার পাপের শাস্তি আমার বাবা-মা কেন পেল, বল তো?” আমার কাছে কোন উত্তর নেই দেবার মতো। আমি চুপ করে থাকি।

রাত দশটা বাজে। মজনু তার বাবা-মায়ের একটা ছবি বুকে চেপে ধরে ঘুমিয়ে গেছে।

মজনু ঘুমিয়ে গেলে আমি নিকষ কালো রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। এইসবের শেষ কোথায়?
***

মাথা ধরেছে প্রচন্ড। ওষুধ খেয়ে মাত্র শুয়েছি। সব কেমন যেন ভজকট পাকিয়ে গেছে। বাবাকে প্রশ্ন করার আগেই মজনু ভাইয়ের বাবা-মা মৃত্যুবরণ করলেন। আর আপুও মজনু ভাইয়ের সঙ্গে তার বাসায় চলে গেল। তারা না আসলে বাবাকে এই বিষয়ে কোন প্রশ্ন করতে পারছি না। এদিকে দাদীর শরীরটাও খারাপ যাচ্ছে। এই অবস্থায় এসব কথা তুলব কি না, তোলা ঠিক হবে কি না, কিছুই বুঝতে পারছি না। ইদানিং মানিককে দেখলে আমার কেমন যেন আজব লাগে! যেই মানিককে এত ভালোবাসি, তাকে দেখলেই মনে হয়, ও তো আমার সৎভাই!

তার কথা ভাবতে ভাবতেই মানিক এসে বলল, মধু আপু!
– বল।
– সমুদ্র ভাইয়া তোমাকে ডাকছে।
– কোথায় সে?
– বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।
– কী আশ্চর্য! তাকে ভেতরে আসতে বল।
– বলেছে আসবে না। তোমাকে বাইরে ডেকেছে।

আমি বিরক্ত হয়ে বাইরে বেরিয়ে সমুদ্র ভাইয়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম।

জিজ্ঞেস করলাম, ভাইয়া, কিছু বলবে?

ভাইয়া মাথা নাড়ে।

– ভেতরে এসো।
– নাহ! আমি ভেতরে যাব না। এখন রাতেরবেলা ভেতরে গেলে সবাই কী বলবে?
– কী আবার বলবে? তোমার মামার বাসা…
– না শোন মধু… ইয়ে…
– কিছু হয়েছে ভাইয়া?, আমি উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করলাম।
ভাইয়া বিচলিত কণ্ঠে বলল, মধু, আমি জানি না ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি কি না!
– কী সিদ্ধান্ত?, জিজ্ঞেস করার সময় আমার গলাটা একবার কেঁপে গেল! আমি একটু একটু বুঝতে পেরেছি ভাইয়া কী বলার চেষ্টা করছে!
ভাইয়া এবারে শান্ত কণ্ঠে বলে, আমি ঠিক করেছি ফ্যামিলি থেকে আমাদের বিয়ের জন্য যেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, সেটা মেনে নেব।

আমি এই আশঙ্কা-ই করেছিলাম! আমি গলায় কোন জোর পেলাম না।

তবুও চেষ্টা করে বললাম, কী বলছ এসব?
– তুমি শুনেছ।
– পাগলামি করো না ভাইয়া!
– আমি পাগলামি করছি না!
আমি এবারে রেগে উঠে বললাম, আলবাত করছো!
– আস্তে মধু। ঠিক আছে, তোমার যদি মনে হয়, তবে পাগলামি করছি! তবে আমি তোমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি!
– বাঁচানোর মানে? কার কাছ থেকে বাঁচাচ্ছ?
– সমাজের কাছ থেকে। ওই ছবিগুলো…
ভাইয়ার কথা শেষ হওয়ার আগেই বললাম, ওই ছবিগুলো এখনো কেউ দেখেনি। আর ওদিন আমাদের মধ্যে কিছুই হয়নি।
– সেটা আমি-তুমি জানি। আর কেউ জানে না। মজনু ছবিগুলো ছেড়ে দিলে কী হবে মধু?
আমি চিবিয়ে চিবিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কবে থেকে এত দয়াবান হয়ে গেলে তুমি? কবে থেকে?

ভাইয়া চুপ করে রইল।

আমি ফুঁসে উঠে বললাম, আর আমাকে সাহায্য করার জন্য মাথার দিব্যি কে দিয়েছে তোমাকে?
– মাথার দিব্যি কেউ দেয়নি। তবে নানি বলেছেন।
– দাদী বলেছেন মানেটা কী? দাদী কি কথা বলতে পারেন?
– না। ইশারায় বোঝাতে তো পারেন। আম্মা নানির কাছে এই প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন। নানি সম্মতি দিয়েছেন। আর সেই সাথে আমাকে আলাদা করে ডেকে বলেছেন, আমি জানি তোমাকে বাঁচাই। আসলে আমার মনে হয়, নানি জানেন যে মজনু মৌসুমীকে ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে করেছে।

আমার মাথায় আগুন জ্বলছে। এসব কথার মানে কী?

আমি স্থির দৃষ্টিতে সমুদ্র ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

এরপর ধীরে ধীরে প্রশ্ন করলাম, ভাইয়া! সত্যি করে বল তো! তুমি কি আপুর ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছ?
ভাইয়া চোখ কপালে তুলে বলল, প্রতিশোধ!
– হ্যাঁ! আপু বিয়ে করেছে, আর তাই তুমিও আমাকে বিয়ে করতে চাইছ?

সমুদ্র ভাইয়া হাসল। হলদে আলোয় বড্ড ম্লান দেখাল সেই হাসি!

– তোমার বুঝি তাই মনে হয়, মধু?

আমি জবাব দিলাম না।

সমুদ্র ভাইয়া ম্লানমুখেই বলল, আমি জীবনে একজনকেই ভালোবেসেছি মধু। সে কে, সেটা তুমি জানো। আর প্রতিশোধ নেয়ার হলে অনেক আগেই নিতে পারতাম, তাই না?

আমি এবারও কোন কথা বললাম না।

ভাইয়া ঠান্ডা গলায় বলল, আর মৌসুমী কেন বিয়ে করেছে, সেই কারণ অনেকটাই স্পষ্ট! এরপরেও আমি কেন প্রতিশোধ নেব? আমার সম্পর্কে তোমার এই ধারণা মধু?

সমুদ্র ভাইয়া মনে হয় কষ্ট পেয়েছে। আমি অবশ্য তাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য কিছু বলিনি। রাগের মাথায় বলেছি!

আমি কিছু বলার আগেই ভাইয়া বলল, আমি আসি। একটা কথা মধু। আমি আমার পরিবারের বিপক্ষে কখনো যেতে পারি না। আমার সেই সাহস বা ইচ্ছে কোনটাই নেই।

আমি সেখানে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থেকে তার চলে যাওয়া দেখলাম।
***

একসপ্তাহ পর…

প্লাবনদের বাসায় প্লাবন, মজনু আর রাহাত একসঙ্গে বসেছে।

প্লাবনের কথা শুনে মজনু মাথা নেড়ে মুখ শক্ত করে বলল, এটা আমি কিছুতেই পারব না।

[চলবে]