হক নিবাস পর্ব-০৮

0
196

#গল্প
#হক_নিবাস
#পর্ব_৮
-শাতিল রাফিয়া

মজনুর কথা শুনে প্লাবনের ভ্রু কুঞ্চিত হলো।

সে থমথমে মুখে প্রশ্ন করে, কী বললে মজনু ভাই?
মজনু কড়া গলায় জবাব দিল, বলেছি যে আমি পারব না। এই কাজ আমি করব না!
– আর এতক্ষণ ধরে আমি যে কথাগুলো বললাম? পুরনো সব কথা শেয়ার করলাম? সেগুলো কি তোমার মনে একটুও দাগ কাটেনি?
মজনু বলল, প্লাবন, আমার খারাপ লেগেছে। কিন্তু যে কথাগুলো তুমি বলেছ, তার সাথে আমার কোন সংযোগ নেই। আর আমার মনে হয়, তোমারও নেই!
প্লাবন চোখ কপালে তুলে বলে, আমার সংযোগ নেই? তাই নাকী? তোমার মাথায় কি কিছুই ঢোকে না মজনু ভাই?

মজনু বিরক্ত হয়ে তাকাল।

এরপর বলল, সে যাই হোক, আমি আর এসবের মধ্যে নেই। আমার মনমেজাজও ভালো নেই।
প্লাবন শক্ত কণ্ঠে বলে ওঠে, তুমি কথা দিয়েছিলে মজনু ভাই।
মজনু শক্ত গলায় বলল, দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন আমি আর সেই কথা রাখতে পারছি না।
প্লাবন ধমকে ওঠে, মজনু ভাই!
– চোখ রাঙিও না!
রাহাত এবারে বিরক্ত হয়ে বলে, ওহ! কী শুরু করলে তোমরা? আচ্ছা, মজনু ভাই না করলে আমি-ই কাজটা করবো নে। আমাকে আমার পেমেন্ট দিলেই হবে।
প্লাবন স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, না। আমি চাই কাজটা মজনু ভাই করুক।

মজনু চোখমুখ শক্ত করে মাথা নাড়ে।

প্লাবন একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, ভেবে দেখ মজনু ভাই। আমি কিন্তু টাকা দিয়ে তোমার কবিতার বই ছাপিয়ে দিতে পারব। আমার একজন প্রকাশকের সঙ্গে ভালো খাতির আছে।

মজনুর মুখে একটা যন্ত্রণার চিহ্ন ফুটে ওঠে।

সে তবুও জোরে মাথা নেড়ে বলে, আচ্ছা প্লাবন, আমি যেই ছাইপাঁশ লিখি, সেগুলো তোমার কবিতা বলে মনে হয়? চাই না এসব আলতু ফালতু জিনিস ছাপাতে।
প্লাবন এবারে রেগে উঠে বলল, সত্যি কথা বল মজনু ভাই। তুমি আসলে প্রেমে পড়ে গেছ, তাই না? তুমি মৌ আপুর প্রেমে পড়ে গেছ!
– নিজের বউয়ের প্রেমে পড়া দোষের কিছু নয়।
– হুহ! বউ! সে কি তোমাকে নিজের স্বামী হিসেবে মানে?
স্বাভাবিক গলায় মজনু বলে, না, মানে না। আমি মৌসুমীর জায়গায় থাকলে আমিও মানতাম না।
কৌতুক ভরা গলায় প্লাবন বলল, তাই? মজনু ভাই, ক’টা মেয়েকে এই পর্যন্ত প্রেম নিবেদন করেছ ভুলে গেছ বুঝি?

মজনু কঠিন চোখে তাকায়!

প্লাবন বলতে থাকে, পাড়ায় এমন কোন মেয়ে নেই, যাকে তুমি উত্যক্ত করনি, এমন কেউ নেই যাকে নিয়ে তুমি কবিতা লেখনি! আর এখন এই এক মাসের বিয়ে…
প্লাবনের কথার মাঝখানেই মজনু ধমকে ওঠে, চুপ!
এরপর হিসহিস করে বলল, হ্যাঁ করেছি। এই এলাকার সব মেয়েকে আমি প্রেম নিবেদন করেছি, তাদের নাম নিয়ে কবিতা লিখেছি। কারণ আমি তখন ছিলাম উড়নচণ্ডী এবং বখাটে। সেই কবিতাগুলোর মধ্যে কোন আবেগ ছিল না, না ছিল কোন প্রেম-ভালোবাসা। শুধুমাত্র মজা নেয়ার উছিলায়, মেয়েগুলোকে ডিস্টার্ব করতেই করেছিলাম!
রাহাত জিজ্ঞেস করে, তাহলে কি তুমি এখন ভালো হয়ে গেছ?
– ভালো হয়ে গেছি কি না জানি না। তবে বদলে গেছি নিশ্চয়ই। রাহাত, তুমি তো মাধুরীকে ভালোবাসনি, কিন্তু আমি মৌসুমীকে…
রাহাত বিরক্ত হয়ে বলে, নিজেরটা চিন্তা করো। আমাকে ভালোবাসার পাঠ পড়াতে এসো না!
মজনু রাহাতের কথার পাত্তা না দিয়ে বলতে থাকে, আমি মৌসুমীকে ভালোবাসি, সে আমাকে ভালো না বাসলেও আমি তাকে ভালোবাসি।
প্লাবন এবারে প্রশ্ন করে, আর সেটা কবে থেকে হলো?
– যেদিন আমি ওকে বিয়ে করেছি, সেদিন-ই ওর চেহারার দিকে তাকিয়ে আমার বুকের ভেতরটা তোলপাড় হয়ে গিয়েছিল। একটা মেয়ে, নিজের পরিবারের জন্য এতটা করেছে! এমনকি সে তার ভালোবাসার মানুষটাকে পর্যন্ত বিসর্জন দিয়েছে! কিন্তু তবুও তখন আমি বই ছাপানোর নেশায়, টাকার নেশায় বুঁদ হয়ে ছিলাম। এরপর ধীরে ধীরে দেখলাম, নিজের পরিবারের মানসম্মান বাঁচাতে মৌ সেই পরিবারের বিপক্ষেই চলে যাচ্ছে! আমি যা বলছি, সেটাই মেনে নিচ্ছে! তার ভালোবাসার মানুষের বিয়ে তার-ই ছোটবোনের সঙ্গে হতে যাচ্ছে জেনেও চুপ করে আছে! এতসব দেখে, ধীরে ধীরে মৌ আমার হৃদয়ে ঢুকে গিয়েছে! তবে হ্যাঁ… আমি তাকে সেটা কখনোই বুঝতে দেইনি! আমার মত লাফাঙ্গা ছেলেকে ভালোবাসার কোন দরকার নেই। আমি-ই নাহয় ওকে একতরফা ভালোবেসে যাব!
মুখ বাঁকিয়ে প্লাবন বলে, এই সিনেমার ডায়ালগ শুনতে একদম ভালো লাগছে না!
মজনু ম্লান হেসে বলল, তোমার কাছে মনে হতেই পারে সিনেমার সংলাপ, কিন্তু আমি আমার সত্যিকারের অনুভূতি প্রকাশ করেছি। মৌসুমী এমন একজন মেয়ে, যাকে ভালো না বেসে পারা যায় না। এই যে আমার বাবা-মা মারা গেলেন, তার তো কোন প্রয়োজন ছিল না আমার সাথে আমার বাসায় যাওয়ার। সে খুব সহজেই পারতো আমার কাছ থেকে মুক্তি পেতে। কিন্তু নিজ পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে সে আমার কাছে এসেছে। আমাকে মানসিকভাবে সাহায্য করেছে। আমাকে ভেঙে পড়া থেকে টেনে তুলেছে।
প্লাবন এবারে মাথা নেড়ে বলল, মজনু ভাই, আসলে আন্টি-আঙ্কেল মারা গেছেন তো, তোমার মাথাটা ঠিক নেই। তুমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে আছ। তুমি একটু সময় নিয়ে ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখ…
মজনু শান্ত গলায় বলে, আমি ঠান্ডা মাথায়-ই বলছি। আমি এইকাজ করতে পারব না। আমার মাথার ওপর থেকে মা-বাবার ছায়াটা চলে যাওয়ার পরে আমি বুঝতে পেরেছি জীবনটা ছেলেখেলা নয়। এভাবে মানুষের ক্ষতি করে, মানুষকে ঠকিয়ে বেশি দূর যাওয়া যায় না! আর আমি তাই তোমাদেরকেও বলছি, তোমরাও এই পথ থেকে সরে এসো।
মুখ বিকৃত করে প্লাবন বলে, সরে আসব? ছেড়ে দেব ওদের এত সহজে?
– এতে তো ওদের কোন দোষ নেই। যার দোষ তার সাথে কথা বলো। তাকে দোষ স্বীকার করে নিতে বলো।
প্লাবন এবার ভয়ানক ভাবে রেগে উঠে বলল, শাট আপ! সে দড়াম করে সেন্টার টেবিলে একটা লাথি মারে!
চিবিয়ে চিবিয়ে প্লাবন জিজ্ঞেস করল, তোমার সাথে কি আমার এই ডিল হয়েছিল, মজনু ভাই?
ঠান্ডা স্বরে মজনু বলে, নাহ! তবে যেই ডিল-ই হোক না কেন, ডিলের কোথাও এমন কোন শর্ত ছিল না যে আমি কাজ ছেড়ে বেরিয়ে যেতে পারব না!

প্লাবন আবার মুখ খোলার আগেই বাইরে থেকে হঠাৎই খুটখাট করে একটা শব্দ এলো।

প্লাবন ঝট করে ঘুরে তাকিয়ে গলা চড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, কে ওখানে?

মনে হল কেউ একজন বা কিছু একটা দৌড়ে পালাল। প্লাবন, রাহাত আর মজনু তাড়াতাড়ি বাইরে গেল। আসেপাশে, দূরদূরান্ত পর্যন্ত অন্ধকার। তারা কাউকে দেখতে পেল না।
রাহাত বলল, বেড়াল মনে হয়।
চিন্তিত হয়ে প্লাবন বলে, হতে পারে।
ভেতরে ঢোকার পর মজনু আবার বলল, আমি আবারও বলছি, এসব থেকে তোমরা বেরিয়ে এসো, প্লিজ। নিজেদের ভবিষ্যত এভাবে নষ্ট করো না।
প্লাবন চিৎকার করে বলে, চুপ থাক তুমি। নিজে তো আমার সাথে ধোঁকাবাজি করলে, বিশ্বাসঘাতক… আবার এখন এসেছে ভালোকাজ করাতে! চোরের মায়ের বড় গলা! আমার যা খুশি আমি করব।
মজনুও কড়া গলায় বলল, তাহলে আমিও সবাইকে সব সত্যি খুলে বলব।

প্লাবন ভয়ানক চোখে মজনুর দিকে তাকাল। এরপর তার দিকে এগিয়ে গেল।
***

অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করে আছি। মজনু সেই যে বাইরে গিয়েছে, আসার নাম নেই! এই সাতদিন আমি মজনুর বাড়িতেই ছিলাম। সে মানসিকভাবে একেবারেই ভেঙে পড়েছিল। খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল। তাকে আমি সাহস দিয়েছি, সাপোর্ট দিয়েছি। আজকাল মজনু আর আগের মত ফালতু কথা বলে না। আউল ফাউল ফাজলামো করে না। সে অনেক বদলে গেছে। তার মা-বাবা চলে যাওয়ার পর তার মানসিক বয়সও যেন অনেক বেড়ে গেছে! এই ক’দিন সে বাসায়ই ছিল। আজ একটা ফোন পেয়ে সে বাসা থেকে বের হয়েছে। আমাকে বলে গেছে তৈরি হয়ে থাকতে। সে এসে আমাকে আমার বাসায় দিয়ে আসবে। সেও কি আবার আমার বাসায় থাকা শুরু করবে কি না, অথবা এই বাসাটার কী হবে, সেটা নিয়ে কিছু বলেনি। তবে তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয়, আমাকে সে এই সম্পর্ক থেকে মুক্তি দিতে চায়। সেটাই ভালো। তবে সে মুক্তি দিলেই কি আসল মুক্তি আসবে! আসল ঝামেলা তো বাঁধিয়ে রেখেছে অন্য কেউ, অন্য একজন!

আমার মোবাইলে একটা ম্যাসেজ আসে, “মৌ আমি একটা কাজে আটকে গেছি। আমাকে কাজে বাইরে যেতে হবে। কবে ফিরব জানি না। তুমি বাড়ি ফিরে যাও।”

ম্যাসেজটা পড়ে মজনুকে ফোন দিলাম। ফোন বন্ধ আসে। মেজাজটা প্রচন্ড খারাপ লাগল! লোকটার একটুও দায়িত্বজ্ঞান নেই! আমি নিজেই বাসায় চলে গেলাম।

বাসায় সবাই আমার সাথে শীতল আচরণ করল, মা বাদে। বাকী কারো যেন কিছুই যায় আসে না আমার থাকা বা না থাকায়! মধু শুধু একবার মজনুর কথা জিজ্ঞেস করল।
***

আজ শুক্রবার। আজ সবাই বাসায়। একটু আগে প্লাবনও এসেছে। আপু কাল রাতে বাসায় ফিরেছে। মজনু ভাই কবে আসবে জানি না। আমি আর দোটানায় থাকতে চাই না। অনেক হয়েছে। এই মানসিক যন্ত্রণা আর সহ্য হচ্ছে না আমার! আমি আজই বাবাকে সব জিজ্ঞেস করব। ফোন করে সমুদ্র ভাইয়াকেও আসতে বলেছি ফুপুসহ। সবাই আসলে আমি সবাইকে ড্রয়িংরুমে জড়ো করলাম।

বাবা জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে মাধুরী? সবাইকে ডেকেছ কেন?
আমি কোন ভণিতা না করে প্রশ্ন করলাম, মানিক কার ছেলে বাবা?

কথাটা বলতে আমার একটুও বাঁধল না! আমি কেমন নির্লিপ্ত হয়ে গেছি! আমি ভেবেছিলাম মানিক হয়তো কথাটা শুনে সবচেয়ে বেশি রিঅ্যাক্ট করবে! কিন্তু তার দিকে তাকিয়ে দেখি সে মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে! আচমকাই সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল!

কিন্তু বাকী সবাই চমকে ওঠে!

আপু চাপা গলায় বলল, মধু!
আমি তীব্র কণ্ঠে বললাম, আজ আমাকে থামাস না আপু!

মায়ের ঠোঁট জোড়া হঠাৎই কাঁপতে থাকে। মা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন। আর বাবার দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনি বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন! হঠাৎ-ই উনি চোখ নামিয়ে নিলেন।

প্লাবন বলে, ওমা! এসব কী কথা মধু! মানিক.. ম.. মানিক অন্য কারো ছেলে? মানে? চাচা আর অন্য কারো ছে..

প্লাবন কথাটা শেষ করার আগেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে! পেছনে তাকিয়ে দেখি মানিক একটা লোহার রড দিয়ে তার মাথার পেছনে বাড়ি মেরেছে! ক্রোধে তার পুরো শরীর কাঁপছে!

[চলবে]