হক নিবাস পর্ব-০৯

0
194

#গল্প
#হক_নিবাস
#পর্ব_৯
-শাতিল রাফিয়া

মানিকের কান্ড দেখে আপু আর আমি একসাথে চিৎকার করে উঠলাম!

মানিক রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে, এই… এই শয়তানটার জন্য আমার বড় বোন একটা বখাটে কবিকে বিয়ে করে নিজের জীবন নষ্ট করেছে! এর জন্যই আমার ছোট বোনের মানসম্মান হুমকির মধ্যে পড়েছে!

এরপর সে বাবার দিকে তাকিয়ে হিসহিসিয়ে বলল, আর এই লোকটা… এই লোকটার জন্য আমার জীবন পুরোটা নষ্ট হয়েছে। না আমি আমার নিজের মায়ের ভালোবাসা পেয়েছি, না আমি অন্যের কাছ থেকে মায়ের ভালোবাসা পেয়েছি!

শেষের কথাটা মানিক আমার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল! মা কথাটা শুনে কেঁপে উঠলেন! তার চোখের জলের পরিমাণ বেড়ে গেল!

আমি জিজ্ঞেস করলাম, মহিলাটি কে ছিলেন বাবা?
মানিক এবার হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, প্লাবনের খালা! আমার আসল মা ছিলেন জোহরা বেগম, প্লাবনের খালা!

ঘরের মধ্যে মনে হয় একটা বোমা পড়ল! বাবা মুখ নিচু করে রাখলেন।

ফুপু বললেন, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। এখানে এসব কী হচ্ছে?
সমুদ্র ভাইয়া জবাব দিল, সেসব পরে সবাইকে বুঝিয়ে বলা যাবে। আগে প্লাবনকে হসপিটালে নিতে হবে।

প্লাবনকে হাসপাতালে ভর্তি করে, সব কিছু ঠিকঠাক করে, চাচাকে তার কাছে রেখে, আমরা আবার আমাদের বাসায় আসলাম। এরপরে সবাই মিলে দাদীর ঘরে বসলাম। দাদী সবই শুনেছেন। উনি নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিয়েছেন।
বাবার দিকে তাকানোর কোন রুচি আর হচ্ছে না। আর বাবা-ও আর কোন কথা বলছেন না।

ফুপু সবার আগে জিজ্ঞেস করলেন, প্রথম থেকে পুরোটা কে গুছিয়ে বলতে পারবে?
সমুদ্র ভাইয়া সবার আগে বলল, প্রথম থেকে আমরা জানি না। তবে আমার আর মধুর সন্দেহ হয়েছিল যে হয়তো মৌসুমী চাপে পড়ে বিয়েটা করেছে। আর সেজন্য আমরা মৌসুমীর মোবাইলটা চেক করেছিলাম।

আপু ঝট করে ঘুরে তাকায়।

আমি মাথা নেড়ে সেদিনের ঘটনা সবটা খুলে বললাম। আর তখন আমার আর রাহাতের কাহিনিটাও বেরিয়ে এল। কোন উপায় ছিল না! আমাকে তো সবটা বলতেই হত।

আমার আর রাহাতের কথা শুনে মা বললেন, চমৎকার! বাবা, মেয়ে সকলের চরিত্র একইরকম হয়েছে।
সমুদ্র ভাইয়া মাথা নেড়ে বলল, না মামী। এখানে মাধুরীর দোষ নেই। ওর সুযোগ নেয়া হয়েছে। আর ওদের মধ্যে সেদিন কিছুই হয়নি।
আপু মানিককে জিজ্ঞেস করে, তুই কী করে জানলি? আর প্লাবনের জন্য এসব হয়েছে মানে?
মানিক ধীরে ধীরে বলতে শুরু করে, ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি মা আমাকে সেভাবে আদর করেন না। আপুদের করেন। তাদের ভালোবাসেন, জড়িয়ে ধরেন, শাসন করেন। কিন্তু আমাকে কিছুই করেন না, এমনকি বকাও দেন না! আমার সাথে উনি সেভাবে কথাও বলেন না। মা আমাকে কখনো জড়িয়ে ধরেছেন, বা চুমু দিয়েছেন, এরকম কোন কিছু আমার স্মৃতিতেই নেই! ছোটবেলা থেকে এটাও দেখেছি মা, বাবার সাথেও কথা বলেন না। এর উত্তর আমি অনেকের কাছে খুঁজেছি। কিন্তু পাইনি। ছোটবেলা থেকে মা আদর না করলেও, বাকীরা আমাকে অনেক আদর করতো। আর বাইরের মানুষের কথা বললে প্রথম নামটাই আসবে – প্লাবন ভাই। প্লাবন ভাইয়া আমাকে যতটা আদর করতো, কোন আপন ভাইও মনে হয় তার নিজের ভাইকে করে না! একদম আমাকে পারলে নিজের কাছে রাখতো। আমি ভেবেছিলাম, হয়তো তার বাবা-ভাইকে কাছে পায় না বলে এমনটা করে। কিন্তু গতকাল আমি এক কঠিন সত্যের মুখোমুখি হলাম।
আমি কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, কী সত্যি?
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মানিক বলে, আমার মন খারাপ থাকলেই আমি সবসময় প্লাবন ভাইয়ের কাছে যেতাম। যেভাবেই হোক, সে আমার মনটাকে ভালো করে দিত। অশান্তি লাগলেই, আমি ছুটে যেতাম তার কাছে। গত একমাস ধরে বাসায় কী অশান্তি চলছে, সেটা সবাই জানো। তার মধ্যে, আপু মজনুর সাথে চলে গিয়েছে, গতকাল হঠাৎই খুব অশান্তি লাগছিল। তাই আমি আবার প্লাবন ভাইয়ের বাসায় গিয়েছিলাম। আগে সন্ধ্যার পর কখনো উনার বাসায় যাইনি। তাই হয়তো সে আশা করেনি যে কেউ যাবে আর কিছু কথা শুনে ফেলবে!
– কী কথা?, চাচী প্রশ্ন করলেন।
– ওখানে গিয়ে ঢোকার আগেই আমি শুনি ভেতর থেকে প্রচন্ড কথা কাটাকাটির শব্দ আসছে। জানালা খোলা ছিল। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে আমি দেখি প্লাবন ভাই, রাহাত ভাই আর মজনু ভাই বসে আছে। প্লাবনের মুখে ‘আহসান’ নামটা শুনলাম। বাবার নাম শুনে আমার জানার আগ্রহ বেড়ে গেল। আর বাবাকে প্লাবন কেন নাম ধরে ডাকলো সেটা বুঝলাম না। আমি ভেতরে না ঢুকে জানালার পেছনে লুকিয়ে পড়লাম। তখন সম্পূর্ণ কাহিনিটা শুনলাম। প্লাবন বলল যে…

মা এতক্ষণ কোন কথা-ই বলেননি।

এবারে উনি মানিককে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আমি চাই কথাগুলো আহসান সাহেব নিজে বলুন।

বাবা চমকে, কেঁপে উঠলেন।

মা দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, নিজের মুখে, নিজের মেয়ে আর বোনের সামনে উনি তার কেচ্ছা শোনান। উনি আর উনার মা কীভাবে একটা মেয়েকে অপমান করেছিলেন! কীভাবে তাকে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দিয়েছিলেন!

বাবা এতক্ষণ পরে মুখ খুললেন।

উনি খুব আস্তে আস্তে বললেন, হ্যাঁ! মানিক আমার আর প্লাবনের খালা জোহরার ছেলে!
ফুপু চেঁচিয়ে ওঠেন, ছি! ছি ভাই! আ… আমি তো এসব জানি না! তুমি এতটা নীচ!
মা বললেন, জানো না, কারণ তোমাদের জানানো হয়নি। তুমি তখন সমুদ্রের বাবার চাকরির সুবাদে অন্য জেলায় থাকতে! সেখানে তোমাকে জানায়নি তোমার গুনধর ভাই, আর তোমার মা!
ফুপু বললেন, কিন্তু ভাবী! তুমিও আমাকে কোনদিন বলনি! একবারের জন্যও না!
মা কাষ্ঠ হেসে বললেন, আমাকে বলতে বারণ করেছিলেন আমার শাশুড়ি। বলেছিলেন, আমি কিছু বললে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিবেন, আমার নামে খারাপ কথা রটাবেন! আমি সেরকম শিক্ষিত নই। কোনমতে ম্যাট্রিক পাশ করেছিলাম! আমার বাপের বাড়িতে বাবা-মা দুইজনেই গত হয়েছেন। ভাইয়ের বাসায় গিয়ে দুইদিন থাকার পরেই ভাবী পাঠিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে যায়! এই অবস্থায় আমাকে বের করে দিলে আমি কোথায় যাব? আর তার চেয়েও বড় কথা, তোমার মা বলেছিলেন, আমার দুই মেয়েকে দেবেন না। মা হয়ে আমি কী করে পারতাম আমার দুই মেয়েকে রেখে চলে যেতে? ওরা তো মা ছাড়া বড় হত! আর তোমার মা আর ভাইয়ের যেই রূপ, শিক্ষাটাও পেত তাদের মতই নীচ মানসিকতার! আর আমার নামে কুৎসা প্রচার করলে আমার মেয়ে দু’টোর ওপর দিয়ে কী যেত? অনেক কিছু ভাবনার বিষয় ছিল! অনেক কিছু ভেবেচিন্তে, নিজের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে, আমি থেকে গেলাম এই বাসায়! একটা পাথরে পরিণত হলাম, শক্ত পাথর!
আপু বলে, দাদী কিন্তু কাজটা করেছিলেন!
চাচী জিজ্ঞেস করলেন, আম্মা কী করেছিলেন?
– আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম এমন কী হয়েছে যে মা-বাবা এত বছর কথা বলেন না? দাদী বলেছিলেন, মানিক মা আর তার কোন প্রেমিকের ছেলে!

সবাই চমকে উঠে বিস্ফারিত চোখে দাদীর দিকে তাকালো! দাদীর চোখে আমরা স্পষ্ট লজ্জা দেখতে পেলাম! তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো! উনি আমাদের কারো সঙ্গে চোখ মেলালেন না!

মা মুখ কুঁচকে বললেন, ছি! নিজের ছেলের কুকর্ম আমার ওপর চাপিয়েছেন! আর তাই হয়তো আজ আপনার এই দশা! আপনাকে আমি কোনদিন ক্ষমা করব না!
মানিক হঠাৎ মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, মানছি তুমি আমার মা নও। কিন্তু অন্য কারো তো মা! মেয়েদের কথা চিন্তা করে এত কিছু সহ্য করে গেলে, এত কিছু চেপে গেলে, কিন্তু একবারও মনে হল না, এই ছোট ছেলেটারও আদর, ভালোবাসা পেতে ইচ্ছে করে? একবারও মায়া হল না আমার ওপর?

মায়ের ঠোঁট দু’টো কাঁপতে থাকে!

এরপর ধীরে ধীরে উনি বললেন, লাগতো! কিন্তু তোমাকে দেখলেই আমার জোহরার কথা মনে হত। মনে হত, তুমি তো আমার ছেলে নও!
মানিক বিষদৃষ্টিতে চেয়ে বলে, এখানে আমার কী দোষ?
হঠাৎই সে চিৎকার করে ওঠে, বল সবাই! আমার কী দোষ? আমি কী করেছি?

সমুদ্র ভাইয়া মানিককে ধরে রাখল।

নরম গলায় বলল, তোমার কোন দোষ নেই মানিক! তুমি পরিস্থিতির স্বীকার!

কিছুক্ষণ সবাই চুপ করে থাকার পর ভাইয়া আবার বলে, আমরা মামার কাছ থেকে কিছু শুনছিলাম। মামা পুরো ঘটনাটা খুলে বলো।

[চলবে]