হক নিবাস পর্ব-১০

0
194

#গল্প
#হক_নিবাস
#পর্ব_১০
– শাতিল রাফিয়া

বাবা তবুও চুপ করে বসে রইলেন। এবার আমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটলো।

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, বাবা আমরা অপেক্ষা করে আছি।
মা মুখ বাঁকিয়ে বললেন, নিজের কেচ্ছার কথা এবার নিজের মেয়েদেরকে শোনাও।

বাবা তবুও মাথা নিচু করে, চুপ করেই বসে রইলেন আরো খানিকক্ষণ।

এরপর খুব ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন,
“প্লাবন আর ওর বড়ভাই প্রতীকের মা যখন রোড এক্সিডেন্টে মারা যান, তখন প্লাবনের বয়স দুই বছর আর প্রতীকের পাঁচ বছর। প্লাবনের মা আর তোমাদের মা খুব ভালো বান্ধবী ছিলেন। বান্ধবীর মৃত্যুর পরে তার সন্তানদের উনি বুকে টেনে নিয়েছিলেন। প্লাবনের বাবা, এনাম ভাইয়ের পোস্টিং চাকরি ছিল। উনার পোস্টিং ছিল একটা প্রত্যন্ত অঞ্চলে। সেখানে দু’টো বাচ্চাকে নিয়ে যাওয়া এবং সেই সাথে দেখেশুনে রাখা সম্ভব ছিল না। উনি বাধ্য হয়ে প্লাবনের খালা জোহরাকে নিয়ে আসলেন।”

এটুকু বলে বাবা আবার নীরব হয়ে গেলেন।

কিছুক্ষণ সামনের দিকে চেয়ে থেকে এরপর আবার বলতে শুরু করলেন,
” প্লাবনের সাথে মধুর সেই ছেলেবেলা থেকেই খুব খাতির। আমাদের বাসায় সে প্রায় সারাদিন-ই থাকতো। মৌ আর মধুর সঙ্গে খেলতো। আগে আমাদের বাসা আর তাদের বাসা পাশাপাশি-ই ছিল। কিন্তু প্লাবনের মায়ের মৃত্যুর পর তার বাবা বাসা বদলান। হয়তো নিজের স্ত্রীর স্মৃতি যেন বারবার তাড়া না করে তাই! জোহরাও ওই নতুন বাসায়-ই এল। প্লাবন আমাদের বাসায় এসে খেলতো, মাঝেমধ্যে মধুও যেত। আমি-ই নিয়ে যেতাম। অনেক সময় প্লাবনকে বাসায় দিয়ে আসতে কিংবা বাসা থেকে নিয়ে আসতে যেতাম। ভেবেছিলাম ছেলেটার ভালো লাগবে। সে তো আর তার মায়ের একেবারে চলে যাওয়াটা সেভাবে বুঝতে পারছে না। এই ওদের বাসায় যেতে যেতেই আমার জোহরার সঙ্গে আলাপ।”

বাবা আবার মুখ বন্ধ করলেন।

মা হঠাৎই ঝাঁঝিয়ে উঠলেন!

চিৎকার করে প্রশ্ন করলেন, চুপ করে গেলে কেন? বলো সেই আলাপ কীভাবে প্রেম হল, কী করে তোমাদের রঙ্গলীলা শুরু করলে বলো সেটা!

বাবা দুই হাতে মুখ ঢেকে কিছুক্ষণ বসে রইলেন!

এরপর কাঁপা গলায় আবার বললেন, প্রথম দিকে সব একদম স্বাভাবিক ছিল। প্লাবনের বাবা যেহেতু থাকতেন না সেভাবে বাসায় চাকরির জন্য, মেয়েটি দুই বাচ্চাকে নিয়ে একা থাকতো দেখে আমি ওদের দিকে খেয়াল রাখতাম। কিন্তু ধীরে ধীরে আমার মনে হতে লাগলো জোহরা আমার দিকে একটু অন্য নজরে তাকাচ্ছে। আমাকে দেখে একটু বেশি-ই লজ্জা পাচ্ছে, আমার সঙ্গে একটু বেশি-ই হাসছে। আমার সামনে আসছে সাজগোজ করে। আ… আমি… মিথ্যে বলব না আজ! আ..আমিও বাঁধা দেইনি তাকে! আমিও কঠিন গলায় কখনো নিষেধ করিনি।
মা হিসহিস করে বললেন, কারণ তুমিও মজা পেতে শুরু করেছিলে শফিক আহসান হক!
বাবা ভেজা গলায় বললেন, আমি মাঝেমধ্যে ওদের বাসায় চা-নাস্তা খেতাম।

আমি মাঝখানে বাবাকে থামালাম।

জিজ্ঞেস করলাম, কেন জোহরা বেগম প্লাবন আর প্রতীক ভাইয়াকে নিয়ে তার বাবার বাসায় চলে যাননি? একাকী একটা মেয়ে কেন এখানে এভাবে থাকলেন?

জবাবটা মা দিলেন।

মা বললেন, প্লাবনের নানা বাড়ির অবস্থা সেরকম ভালো ছিল না। তারা গ্রামে থাকতেন। আর ওর মামাদের সঙ্গে প্লাবনের বাবার বিরোধ ছিল। তারা প্লাবনের মায়ের মৃত্যুর জন্য ওর বাবাকে দায়ী করেছিলেন। বলেছিলেন উনি পরিবারকে সময় দেন না বলে, মানসিক অশান্তিতে ভুগতে ভুগতে উনার বোন অন্যমনস্ক থাকতেন। অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তা পাড় হতে গিয়ে এক্সিডেন্ট হয়ে মারা গেছেন!
আমি বললাম, চমৎকার! মামার সঙ্গে বিরোধ ছিল, আর এনাম চাচা খালাকে নিয়ে চলে এলেন ছেলেদের দেখাশোনা করার জন্য!
বাবা বললেন, উপায় ছিল না। এনাম ভাইয়ের বাবার বাড়িতেও এমন কেউ ছিল না, যে ওদের দেখে রাখতে পারে, দায়িত্ব নিতে পারে।
ফুপু বললেন, হ্যাঁ তারপর?
ধরা গলায় বাবা বললেন, একদিন সন্ধ্যায় ওদের বাসায় গিয়েছিলাম। প্লাবন বিকেলে এসে মধুর সঙ্গে খেলেছে। ওকে দিতে গিয়েছিলাম। প্রতীকও এলাকার ছেলেদের সাথে খেলাধুলা করে ফিরেছে। ক্লান্ত থাকায় দুইজনই সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে পড়ে। জোহরা আমাকে চা বানিয়ে দিল। চা খেতে খেতে হঠাৎই ঝমঝম করে বৃষ্টি নামলো। আর কারেন্টও চলে গেল! জোহরা বাচ্চাদের ঘরে মোমবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে আরেকটা মোমবাতি জ্বালিয়ে নিয়ে এল। ও.. ওইদিন…
মা হঠাৎই ফিসফিস করে বললেন, মোমবাতির আলো তো আবার অন্য একটা আবেশ সৃষ্টি করে! তার মধ্যে বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যা!

মায়ের দিকে তাকিয়ে আমার বুকের ভেতরটা হঠাৎ দুমড়ে মুচড়ে উঠলো!

বাবা হঠাৎই আবারও দুইহাতে মুখ ঢেকে বসে রইলেন। এরপর ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন।

মা কাঠকাঠ গলায় বললেন, এখন আর মুখ লুকিয়ে কী হবে?
সমুদ্র ভাইয়া বলে, মামা আমরা বুঝতে পেরেছি। তারপরে?
বাবা বললেন, তারপর জানতে পারলাম মানিক আসতে চলেছে পৃথিবীতে। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। আমি স্বার্থপরের মতো ওর কাছ থেকে সরে যেতে চাইলাম। আমি সব অস্বীকার করলাম! কীভাবে আমি এই পাপ করে ফেললাম, সেই অন্যায়, সেই পাপ আর জোহরা সন্তান সম্ভবা এইসব খবর আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেতে লাগলো। জোহরাকে বাচ্চাটা নিতে নিষেধ করেছিলাম। সে জেদ ধরলো এই সন্তান সে পৃথিবীতে আনবেই! আমার তখন পাগল পাগল লাগতো! আমার এই উষ্কখুষ্ক অবস্থা দেখে আমার মা কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছিলেন। উনি আমাকে একদিন চেপে ধরলেন। আমি মায়ের পা ধরে সব খুলে বললাম। মা সব শুনে চুপ করে গেলেন। বেশ ক’দিন অনেক ভাবনা-চিন্তা করে আমাকে নিয়ে জোহরার কাছে গেলেন। তাকে একটা চেইন পরিয়ে দিয়ে আশ্বাস দিলেন আমাদের বিয়ে দেবেন। তার কাছে সময় চাইলেন যাতে তোমার মাকে রাজি করাতে পারেন। আ.. আমার কখনোই ইচ্ছে ছিল না জোহরাকে বিয়ে করার! ব.. বরং আমি তখন তোমার মাকে সত্যিটা জানাতে চেয়েছিলাম। আমি বিয়ে করতে চাইনি। মা আমাকে বললেন বিয়ে করতে হবে না। জোহরাকে আমরা শুধু ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখছি। এই ছলচাতুরীও আমার পছন্দ হচ্ছিল না। মা তখন বলেছিলেন, আমি যদি পরিবারের মানসম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিতে না চাই, হক বংশের সম্মান ধূলিস্যাৎ করতে না চাই, তাহলে যেন তার কথা মেনে চলি। আমি তবুও রাজি না হলে মা আমাকে বললেন, পরিবারের মানসম্মান জলাঞ্জলি গেলে উনি বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করবেন! আমার মায়ের হক বংশ নিয়ে অনেক আত্মঅহামিকা ছিল! নয় মাস জোহরাকে ভুলিয়ে রাখা হল, বিয়ে আর সংসারের স্বপ্ন দেখানো হল। নয় মাস পর মানিকের জন্ম হল। আমার মা মানিককে জোহরার কাছ থেকে কেড়ে নিলেন।
আপু জিজ্ঞেস করে, এই নয় মাসে উনার যে শারিরীক পরিবর্তন হয়েছিল, সেটা কারো চোখে পড়েনি?
– না। কারণ জোহরা তখন এনাম ভাইকে বলেছিল, সে বাড়ি যেতে চায়। কয়েক মাস পর ফিরবে। বাড়ি যাওয়ার নাম করে সে অন্য এলাকায় একটা বাসায় ওঠে। আমার মা-ই সব ঠিক করে দিয়েছিলেন, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা সহ। আর প্লাবনদের দেখাশোনার জন্য মা-ই আমাদের পরিচিত একজনকে নিজ দায়িত্বে ঠিক করে দিলেন। প্লাবনের বাবা তার দুই ছেলে আর সেই মানুষকে নিয়ে তার চাকরির এলাকায় চলে গেলেন। জোহরা ওই বাসা থেকেই ওর বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলতো। নয়মাস পরে মানিককে আমরা কেড়ে নিলাম। আর জোহরা কাঁদতে কাঁদতে আবার ফিরে গেল প্লাবনদের বাসায়। প্লাবনরা তখনো ফেরেনি। মা তাকে হুমকি দিয়েছিলেন, কাউকে কিছু জানালে তাকেই কলঙ্কিত করবেন উনি। উনি বলেছিলেন, জোহরা একা একটা মেয়ে দু’টো বাচ্চাকে নিয়ে থাকতো, এই কথা দিয়েই অনেক ঘটনা বানানো যায়! আর মায়ের মিথ্যে সাক্ষীরও কোনো অভাব হবে না! সমাজের অধিকাংশ মেয়েদের মতো ওই সময়েও জোহরা সাহস দেখাতে পারেনি। সে সব দুঃখ, অপমান থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য আত্মহত্যা করল! আর.. আর আমার মায়ের ব..বংশমর্যাদা, আত্মসম্মান, অহংকার সব রক্ষা পেল! স…ব!

বাবা ডুকরে কেঁদে উঠলেন!

একটা শব্দ করায় আমরা দাদীর দিকে তাকালাম। দাদীর চোখ উপচে সমানে পানি পড়ছে! দাদী আমাদের ইশারায় বোঝালেন উনি আমাদের সবার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী!

আপু ধীর গলায় বলে, আমাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে কী লাভ দাদী?
মা বললেন, আমি কখনোই আপনাকে ক্ষমা করতে পারব না। কক্ষনোই না।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানতে চাইলাম, আর মা কবে এসব জানলেন? আর চাচা-চাচী? প্লাবনরাই বা কখন ফিরে এলো?

[চলবে]