#হতে_পারি_বৃষ্টি
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ২০
তানিয়ার বৌভাতের সেই ঘটনার দুই দিন পর আজ অফিসে এসেছে মিমি। নিজেকে সামলে নিতে তার একটু সময় লেগেছে। সেদিনের কথা ভাবতেই তার নিজের ওপর ঘৃনা হয়। মিসেস ঝর্নার মতে মিমির দোষ ছিল। সত্যিই কি তাই? মিমি জানে না। সেদিনের পর থেকে তানিয়ার সাথে তার কথা হয়নি। সে নিজের ফোন বন্ধ করে রেখেছিল। কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করেনি।
মিমি ঠিক সময়েই অফিসে এসেছে। সে নিজের ডেস্কে গিয়ে বসল। কিছুক্ষণ পর কাইফ লম্বা লম্বা পা ফেলে নিজের কেবিনে প্রবেশ করল। সবার মতো মিমিও দাঁড়িয়ে ছিল। কাইফ চলে যাবার পর সে পুনরায় বসে পড়ল। তার টেবিলে কিছু ফাইল রাখা সেগুলো উল্টে পাল্টে দেখতে লাগল। কারো আওয়াজে মিমি চোখ তুলে তাকাল।
— হ্যালো মিস!
মিমি লোকটাকে চেনে না। এই প্রথম দেখছে। সে ভ্রু কুঁচকে বলল–
— জ্বি।
— আপনি বোধ হয় আমাকে চেনেন না। ওকে সমস্যা নেই আমি আমার পরিচয় দিচ্ছি। আমি আদিল আহসান। মায়ের আদরের ছেলে। এই অফিসেই চাকরি করি। এবার আপনার পরিচয় টা?
মিমি জোর পূর্বক হেসে বলল–
— আমি মারিশা আহমেদ মিমি। স্যারের পিএ।
— কাইফ স্যারের?
— জ্বি।
— ওহ আচ্ছা। আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুবই ভালো লাগল। আপনি কাইফ স্যারের পিএ শুনে আমি একটু অবাক হয়েছি কেন জানেন?
মিমি প্রচন্ড বিরক্ত হচ্ছে। এই মুহূর্তে আদিলের বকবকানি তার পছন্দ হচ্ছে না। লোকটা বেশি কথা বলে। আদিল আবারও বলল–
— আপনি কীভাবে জানবেন? আমিই বলছি। আসলে স্যার নিজের জন্য এতদিন কোনো পিএ রাখেননি। তাই আমি একটু অবাক হয়েছি।
আদিল আরও কিছুক্ষণ বকবক করল। অতঃপর বলল–
— আপনি আমার থেকে ছোট মনে হয়। তাহলে আমি তুমি করেই বলব। ছোটদের সাথে আপনি ঠিক যায় না।
আরো কিছু বলতে নিলেই পিওন এসে হাজির। সে মিমিকে বলল–
— ম্যাডাম! স্যার ডাকছেন।
পিওনকে মিমির বড় একটা ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করল এই বাঁচাল লোকটার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য। মিমি বলল–
— আচ্ছা, আমি যাচ্ছি।
পিওন চলে গেল। মিমি আদিলের দিকে তাকিয়ে বলল–
— স্যার আমাকে ডাকছেন। আপনার সাথে পরে কথা বলব। আমি যাই।
মিমি চলে গেল। আদিলও নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
দরজায় নক করতেই ভেতর থেকে প্রবেশের অনুমতি এলো। যেটা বরাবরের মতই গম্ভীর কন্ঠের ছিল। মিমি প্রবেশের পর কাইফ গম্ভীর কণ্ঠে বলল–
— অফিসটা কাজ করার জায়গা। গল্প করার নয় মিস মিমি।
মিমি হকচকিয়ে গেল। কাইফ কীভাবে জানল যে সে আদিলের সাথে কথা বলেছে? আর সে নিজে তো বলেনি আদিলই আগ বাড়িয়ে এসে তার সাথে কথা বলেছে। কাইফ রাগে ফুঁসছে। মিমির সাথে আদিলকে দেখে তার মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছে। তার রাগ হচ্ছে, প্রচুর রাগ হচ্ছে। মিমি কেন আদিলের সাথে কথা বলবে? শুধু আদিল কেন? মিমি কোনো পুরুষের সাথে কথা বলতে পারবে না। সে বলল–
— অনেক দিন ছুটি কাটিয়েছেন। এবার কাজ করুন। নাহলে আপনার চাকরি টেকার নিশ্চয়তা দিতে পারছি না।
মিমি মুখ গোমড়া করে বলল–
— আমাকে কি করতে হবে, স্যার?
— আগে আমাকে এক কাপ কফি এনে দিন। তারপর বলছি। আর হ্যাঁ কফিটা অবশ্যই ব্লাক কফি।
— জ্বি স্যার।
মিমি সম্মতি দিয়ে বের হয়ে গেল। কাইফ ল্যাপটপের স্ক্রীনে চোখ রাখল। মিমিকে দেখছে সে, অফিসের কোনায় কোনায় সিসি ক্যামেরা লাগানো। কাইফ ল্যাপটপে সব দেখতে পায়।
মিমি ক্যান্টিনে গিয়ে কাইফের জন্য কফি নিয়ে ফিরে আসলো। আসার পথে তার কানে কিছু কথা আসলো। কথা গুলো এমন–
— মোবারক তালুকদারকে নাকি কারা বাজে ভাবে মারধর করে হাসপাতালের সামনে ফেলে রেখে গিয়েছে। তার তো মর মর অবস্থা। আইসিইউতে আছে, বাঁচে না মরে ঠিক নেই। কারা যে এমনটা করল তা পুলিশ জানতে পারেনি। এখনও তদন্ত চলছে।
মিমি যেন জমে গেল। এরা তো সেই লোকটার কথা বলছে যে তাকে কুপ্রস্তাব দিয়েছিল। মিমি কাঁপা কাঁপা পায়ে কাইফের কেবিনে প্রবেশ করল। অন্যমনস্ক থাকায় হাত থেকে কফির কাপ পড়ে গেল। মিমির হুঁশ ফিরল। সে ‘স্যরি’ বলে দ্রুত ভাঙা কাপের টুকরো ওঠাতে গেলেই তার আঙুল কেটে গেল। সে ব্যথাতুর আওয়াজ করে উঠল–
— আহ্!
কাইফ তার শব্দে এগিয়ে এলো। দেখল মিমি হাত বেশ খানিকটা কেটে গিয়েছে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। কাইফ ব্যস্ত ভঙ্গিতে মিমির হাত ধরল। মিমি চোখ বন্ধ করে বলেই যাচ্ছে–
— স্যরি স্যার। বিশ্বাস করুন আমি ইচ্ছে করে ফেলিনি। কীভাবে যেন পড়ে গেল। স্যরি!
মিমির থামার নাম নেই। সে বলেই চলেছে। কাইফ দিল এক ধমক–
— চুপ! আমি কি কিছু বলেছি আপনাকে?
মিমি চুপ হয়ে গেল। কাইফ তার হাত ধরে টেনে বলল–
— উঠুন।
তাকে তুলে কেবিনে রাখা সোফায় বসিয়ে দিল। ফার্স্ট এইড বক্স এনে মিমির পাশে বসল। মিমি ব্যথায় মুখ কুঁচকে রেখেছে। কাইফ ডেটল দিয়ে ধীরে ধীরে জায়গা টা পরিষ্কার করে দিচ্ছে। মিমি ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে বলল–
— উফ্ স্যার! জ্বলছে খুব।
কাইফ আস্তে আস্তে ফু দিয়ে দিল। মিমি কাইফের দিকে তাকাল, হঠাৎ করেই যেন সব ব্যথা ভুলে গেল। ব্যস্ত হয়ে পড়ল সামনে বসে থাকা সুদর্শন পুরুষটিকে দেখতে। খুবই যত্ন সহকারে তার আঙুল ব্যান্ডেজ করে দিল কাইফ। মিমির দিকে তাকাতেই মিমি চোখ নামিয়ে নিল। কাইফ বক্সটা জায়গায় রেখে এসে বলল–
— কোনো কাজই দেখি করতে পারেন না। কি দেখে যে আমার বাবা আপনাকে চাকরি দিল? কে জানে?
মিমি মনে মনে অপমানিত বোধ করল। থমথমে মুখে করে বলল–
— আমি একটু অন্যমনস্ক ছিলাম বলে এমনটা হয়েছে। আমি আপনার জন্য আবার কফি নিয়ে আসছি।
— থাক দরকার নেই। আপনি এখানে চুপ করে বসে থাকুন। ছুটি হলে চলে যাবেন। ছুটি হবার আগ পর্যন্ত এখানেই বসে থাকবেন।
মিমি ইতস্তত করে বলল–
— স্যার! আপনি কি মিস্টার মোবারক তালুকদারের ব্যাপারে কিছু জানেন? না মানে আমি শুনলাম..
কাইফ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল–
— মিস মিমি! আপনার কি মনে হয় আমার কাছে ফালতু সময় আছে? আমি সারা দুনিয়ার খবর রেখে বেড়ায়? আপনাকে চুপ করে বসে থাকতে বলেছি, তাই থাকুন। মুখ থেকে যেন কথা না বের হয়।
মিমি পুনরায় মুখ গোমড়া করে ফেলল। কাইফ যে তাকে এতো কথা শুনিয়ে কি মজা পায়? তা মিমি বোঝে না। কাইফ পিওনকে ডেকে ভাঙা কাপের টুকরো পরিষ্কার করে দিয়ে যেতে বলল। আর নিজের জায়গায় বসে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মিমি বুঝতে পারছে না এতক্ষণ এভাবে বসে থাকা কীভাবে সম্ভব? কিন্তু কিছুই করার নেই কাইফ যখন বলেছে তখন এভাবেই বসে থাকতে হবে। সে গালে হাত দিয়ে বসে রইল। মাঝে মধ্যে আড় চোখে তাকাল কাজে ব্যস্ত পুরুষটির দিকে। তালুকদারের কথা পুরো পুরি ভুলে বসল।
————
তালুকদারের ছেলে রায়হান তালুকদার। কথায় আছে বাপ কা বেটা অর সিপাহী কা ঘোড়া! এদের সাথে তা খাপে খাপ মিলে যায়। তালুকদার যেমন মেয়েবাজ চরিত্রহীন তেমনই তার ছেলে রায়হান তালুকদার। কিন্তু রায়হান তার বাবার থেকেও এক কাঠি ওপরে। সে বর্তমানে হাসপাতালে অবস্থান করছে। তালুকদার মরার মতো পড়ে আছে আইসিইউতে। রায়হান পুলিশ ইন্সপেক্টরের কলার ধরে ঝাঁকিয়ে চেঁচিয়ে বলল–
— আমার বাবার এই অবস্থা কে করেছে? তাকে এখনো ধরতে পারিসনি তোরা? কেমন পুলিশ তোরা? সেই কু/ত্তা/র বা/চ্চা/কে ধরে নিয়ে আয় আমার সামনে। জ্যান্ত পুতে দেব তাকে।
কিছু কনস্টেবল ধরাধরি করে রায়হানকে ছাড়াল। কলার ধরাতে রেগে গেলেও ঘুষখোর ইন্সপেক্টর কিছু বললেন না। তিনি শান্ত স্বরে বললেন–
— উত্তেজিত হবেন না। আমি আমার ফোর্স লাগিয়ে দিয়েছি। যত দ্রুত সম্ভব তাকে ধরতে পারব আশা করি।
রায়হান হিসহিসিয়ে বলল–
— যদি ধরতে না পারিস তাহলে তোদের সব কটাকে শেষ করে ফেলব আমি।
হাসপাতালের সকলে ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। তাদের চেঁচামেচিতে হাসপাতালের রোগীদের অনেক সমস্যা হচ্ছে, কিন্তু ভয়ে ডাক্তার কিছু বলতে পারছে না। বলা তো যায় না, দেখা গেল তাকে মেরে ওপরে পাঠিয়ে দিল। এসব বড় সড় মানুষদের সাথে লাগতে নেই। এরা মানুষই হয় না।
রায়হান আইসিইউতে শুয়ে থাকা বাবার দিকে তাকাল। মূল কথা হলো, মোবারক তালুকদার মরল কি বাঁচল তাতে তার কোনো যায় আসে না। তার চায় সম্পত্তি, যেটা মোবারক তালুকদার তাকে এখনো লিখে দেননি। একটা বার সম্পত্তি লিখে দিক তারপর দরকার হলে সে নিজেই তাকে মেরে ফেলবে। তার হাত কাঁপবে না। সে গোপন সূত্রে খবর পেয়েছে যে এটা কিং এর কাজ। কিং যখন মোবারক তালুকদারকে কাত করেছে এখন তাহলে তার পালা। রায়হান সকল কুকর্মের সাথে জড়িত। কিং তাকে হাতে পেলে নিশ্চয়ই তার বাবার মতো সুযোগ দেবে না, একেবারে শেষ করে দেবে। তাকে খুব সাবধানে থাকতে হবে।
চলবে?
{ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।}
#হতে_পারি_বৃষ্টি
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ২১
সময়টা বিকেল। ব্যস্ত নগরীর সকলে নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। রোদের তেমন তেজ নেই। এমন সময়ই কপোত কপোতী দের ঘুরে বেড়ানোর উপযুক্ত সময়। হাতে হাত রেখে গন্তব্যহীন হয়ে হেঁটে চলা! একটা অন্যরকম সুখানুভূতি। এমন একটা দৃশ্য চোখে ঠেকল সিফাতের। সে তাদের মতোই গন্তব্য হীন, শুধু সে একা একা লং ড্রাইভে বের হয়েছে। সিফাত মনে মনে ভাবে এমন সময় তার পাশে যদি কোনো রমনী উপস্থিত থাকত! তাহলে মন্দ হতো না।
সিফাত বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। মেঘেদের মতোই নিজস্ব বিজনেস তাদের। মেঘ বিয়ের দোহাই দিয়ে বিজনেসে ঢুকে গেলেও সিফাত এখনও বেকার। মেঘ যখন বিয়ের বাহানায় কাজে ঢুকেছে,সেও নাহয় তাই করবে। কিন্তু তার জন্য বিয়ে করা প্রয়োজন, আর বিয়ে করার জন্য প্রয়োজন একটা মেয়ে। এসব ভাবতে ভাবতে সিফাত গাড়ি চালাচ্ছিল। হঠাৎ এক জায়গায় ভিড় দেখে সে গাড়ি থামিয়ে দিল। তার ভ্রু কুঁচকে গেল। মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগল কি হচ্ছে এখানে? এতো ভিড় কেন? সে কৌতুহল দমাতে না পেরে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। ভিড়ের দিকে এগিয়ে গেল, ভিড় ঠেলে চমকে উঠল সিফাত। সেখানে রিহা একটা বাচ্চা ছেলের মাথায় ওড়না চেপে বসে আছে। সমান তালে কেঁদে যাচ্ছে। বাচ্চাটার বয়স কতই বা হবে? নয় কি দশ? রক্তে ভিজে গিয়েছে তার স্কুল ড্রেসের সাদা শার্ট। অথচ লোক জন দাঁড়িয়ে মজা দেখছে, কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে যাচ্ছে না। সিফাত হতদন্ত হয়ে ছুটে গেল। রিহার তার দিকে চোখ পড়তেই সে শব্দ করে কেঁদে উঠল। কাঁদতে কাঁদতে বলল–
— আ আমাকে একটু সা সাহায্য করুন প প্লিজ! ওর অ অনেক রক্ত বের হয়ে গিয়েছে।
সিফাত তাড়াতাড়ি করে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিল। রিহাও তার পিছু পিছু গেল। গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে সিফাত বলল–
— একটা বাচ্চা রাস্তায় রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে, আর আপনারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখছেন? এই বাচ্চাটার জায়গায় যদি আপনাদের কারোর বাচ্চা থাকত? তাহলে কি এভাবেই দাঁড়িয়ে মজা দেখতেন? ছিঃ লজ্জা হওয়া উচিত আপনাদের।
সিফাত গাড়ির সামনে এসে বলল–
— দরজা খোল।
রিহা দ্রুত দরজা খুলে দিল। সিফাত বাচ্চাটাকে শুইয়ে দিয়ে বলল–
— তুমি এখানে ওর মাথা কোলে নিয়ে বসো।
রিহা তাই করল, পাল্টা প্রশ্ন করল না। সিফাত ঝড়ের বেগে গাড়ি ছোটায়। হাসপাতালের সামনে এসে গাড়ি থামায়। বাচ্চাটাকে পুনরায় কোলে তুলে হাসপাতালের মধ্যে ছুটল। রিহাও ছোটে তার পিছু পিছু। সিফাত ডাক্তার নার্স ডেকে তাদের হাতে তুলে দিল। তারা দ্রুত তাকে ইমার্জেন্সিতে নিয়ে গেল। সিফাত ধপ করে বসার জন্য নির্ধারিত জায়গায় বসে পড়ল। রিহা এখনও গুন গুন করে কেঁদে যাচ্ছে। সিফাত তার দিকে তাকায়। কাঁদতে কাঁদতে মুখ লাল হয়ে আছে, গাল দুটো ভেজা। সিফাত শান্ত স্বরে বলল–
— কেঁদো না। ও ঠিক হয়ে যাবে। এখানে বসো।
বলে নিজের পাশে হাত দিয়ে দেখিয়ে দিল। রিহা গুটি গুটি পায়ে গিয়ে বসে পড়ল। সিফাত তাকে জিজ্ঞেস করল–
— কীভাবে হলো?
— আমি টিউশনি করিয়ে বাড়িতে যাচ্ছিলাম। রাস্তায় দেখলাম ও পড়ে আছে। হয়তো কোনো গাড়ি ধাক্কা দিয়ে চলে গিয়েছে। আমি তাকে যেয়ে ধরলাম, সকলের কাছে কত সাহায্য চাইলাম কিন্তু কেউ এগিয়ে আসলো না।
সিফাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এখনকার যুগে সবাই নিজের টাই দেখে। রিহার ওড়নাসহ হাত ভর্তি রক্ত! বাচ্চাটার জন্য এতক্ষণ তার নজরে আসেনি। কিন্তু এখন তার মাথা ঘুরছে, কেমন ঝিমঝিম করছে। দূর্বল রিহার চোখের সামনে আঁধার ছেয়ে গেল। সে ঢলে পড়ল সিফাতের ওপর। ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে তৎক্ষণাৎ রিহাকে ধরে ফেলল সে। গালে চাপড়ে ডাকল। কিন্তু রিহা উঠল না। সে এক নার্সকে ডাকে। নার্স তাকে একটা ফাঁকা কেবিন দেখিয়ে দেয়। সিফাত রিহাকে পাঁজাকোলা করে তুলে কেবিনের বিছানায় শুইয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার এসে তাকে চেক করে একটা সেলাইন লাগিয়ে দিয়ে বলল–
— ওনার ব্লাড ফোবিয়া আছে।আর আগে থেকেই হয়ত দূর্বল ছিলেন। চিন্তা করবেন না সে ঠিক হয়ে যাবে।
সিফাত জিজ্ঞেস করে–
— বাচ্চাটা?
— একদম ভালো আছে। একটু রক্ত ক্ষরণ হয়েছিল আর একটা হাত ভেঙে গিয়েছে। আমরা সব ঠিক করে দিয়েছি। কালই বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবেন।
ডাক্তার চলে গেল। সিফাত রিহার মুখের দিকে তাকায়। মুখটা মলিন হয়ে আছে। ফর্সা গায়ের রং, টানা চোখ, পাতলা ঠোঁট, নাকের পাশে একটা তিল। সিফাতের কাছে তাকে বড়ই মায়াবী মনে হলো। কে বলবে এই মেয়ে একটা ঝগড়াটে? পিচ্চি বললে বিড়ালের মতো খামচি দিতে আসে? সিফাত রিহার রাগী চেহারার কথা কল্পনা করে আর আনমনে হাসে।
———–
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমেছে। পাখিরা ফিরছে নিজেদের নীড়ে। ব্যস্ত নগরী থেমে নেই। মিসেস মুক্তার কেঁদে কেটে বেহাল দশা। তার ছোট মেয়ে এখনও বাড়ি ফেরেনি। যে কিনা সন্ধ্যা হবার আগেই ফিরে আসে, তার কোনো খোঁজ নেই। মিমি ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথা পাইচারি করে যাচ্ছে। রিহার ফোন সে বন্ধ পেয়েছে। তার যতগুলো ফ্রেন্ডের নম্বর তার কাছে আছে , সবার কাছে কল দিয়ে শুনেছে। কিন্তু রিহা কোথাও নেই। চিন্তায় মিমির মাথা ফেটে যাচ্ছে। কোথায় গেল রিহা? কোনো বিপদ আপদ হলো না তো? এদিকে তার মা মরা কান্না জুড়ে দিয়েছে। মিমি বিরক্ত হয়ে বলল–
— উফ্ মা! কাঁদছ কেন? ও ঠিক আছে। আমি একটু এগিয়ে দেখে আসছি। কেঁদো না।
তবুও মিসেস মুক্তা থামে না। দুই মেয়ে তার কলিজার দুই টুকরা। কোনো একজনেরও কিছু হলে তিনি বাঁচবেন না। মিমি বাইরের উদ্দেশ্যে এগিয়ে যেতেই দরজায় নক হলো। মিমি উত্তেজিত হয়ে বলল–
— রিহু চলে এসেছে বোধ হয়।
সে দৌড়ে চলে গেল দরজা খুলতে। দরজা খুলেই রিহাকে আবিষ্কার করল। তৎক্ষণাৎ বোনকে বুকের মাঝে আগলে নিল, যেন তার জান ফিরে পেয়েছে। রিহাকে ছেড়ে তার গালে হাত দিয়ে বলল–
— তুই ঠিক আছিস রিহু? তোর কিছু হয়নি তো?
রিহা মিমিকে আস্বস্থ করে বলল–
— আমি একদম ঠিক আছি আপু।
মিমির চোখ গেল পেছনের দিকে দাঁড়িয়ে থাকা সিফাতের দিকে। মিমি তাকে চিনল, তানিয়ার বিয়েতে ছিল। মিমি ভ্রু কুঁচকে বলল–
— আপনি মেঘ জিজুর বন্ধু না?
সিফাত মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়। রিহা সিফাতকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই মিসেস মুক্তা মেয়ে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদেন। সিফাত তাকিয়ে দেখে। মিমি তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল–
— রিহাকে আপনি কোথায় পেলেন?
সিফাত মিমিকে সকল ঘটনা বিস্তারিত বর্ণনা করে। শেষে বলল–
— বাচ্চাটার স্কুলের কার্ড থেকে তার বাবা মাকে ফোন করে জানিয়ে ছিলাম। তারা আসার পর রিহাকে আমাকে অনেক ধন্যবাদ জানাল। রিহাকে চলে আসতে বলেছিলাম। কিন্তু বাচ্চাটার জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত সে ওখানে বসে ছিল। জ্ঞান ফেরার পর তার সাথে দেখা করে তারপর এসেছে।
— কিন্তু! রিহুর তো ব্লাড ফোবিয়া আছে। ওর কিছু হয়নি তো?
— না না কিছুই হয়নি। ও একদম ঠিক আছে।
সিফাত রিহার অসুস্থ হবার কথা একেবারে চেপে গেল। কারন রিহা তাকে মানা করেছে। মিমি কৃতজ্ঞতার সাথে বলল–
— আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনি যদি না থাকতেন তাহলে বাচ্চাটার হয়তো কিছু হয়ে যেত। আর রিহাও বিপদে পড়ত। আপনি বসুন না? আমি আপনার জন্য চা নাস্তা কিছু নিয়ে আসি।
সিফাত নাকোচ করে বলল–
— ব্যস্ত হবেন না। আগে ওনাকে সামলান।
মিমি মায়ের দিকে এগিয়ে গেল মায়ের কান্না থামিয়ে বলল–
— মা রিহু তো ঠিক আছে আর কেঁদো না। আর দেখো উনি দাঁড়িয়ে আছেন। ওনার জন্য রিহা সুস্থ ভাবে ফিরে এসেছে।
মিসেস মুক্তা শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে সিফাতের সামনে দাঁড়িয়ে বলল–
— তোমাকে যে কি বলে ধন্যবাদ দেব বাবা? এই দুই মেয়ে ছাড়া আমার আর কিছুই নেই। ওর কিছু হয়ে গেলে..
সিফাত তাকে থামিয়ে বলল–
— এভাবে বলবেন না আন্টি। এটা আমার কর্তব্য ছিল। আজ আমি আসি তাহলে আন্টি।
— তুমি তো কিছুই মুখে দিলে না বাবা। এই মিমি ওর জন্য নাস্তা নিয়ে আয়।
— না আন্টি। আমাকে বাড়িতে যেতে হবে। অন্য একদিন এসে খাবো।
সিফাত এক পলক রিহার দিকে তাকিয়ে বের হয়ে গেল। রিহা তার যাবার পথে তাকিয়ে থাকল। লোকটা কেমন যেন আলাদা। অন্যের বিপদে দাঁড়াতে দু বার ভাবে না। তখন কেমন ছুটে গিয়েছিল। নিজের জ্ঞান ফেরার পর সে সিফাতকে নিজের পাশে দেখেছিল। প্রথম দেখা অন্যরকম ভাবে হলেও, সিফাতকে এখন তার বেশ লাগছে। অনন্ত মানুষ হিসেবে সে নিঃসন্দেহে একজন ভালো মানুষ। দেখতেও খারাপ না, সুদর্শন একজন পুরুষ। সিফাতের কথা ভেবেই রিহার মনের মধ্যে ভালো লাগার হাওয়া বয়ে যায়।
চলবে?
{ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)}