হতে পারি বৃষ্টি পর্ব-২২+২৩

0
483

#হতে_পারি_বৃষ্টি
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ২২

অফিসে এসে বসতে না বসতেই কাইফ ডেকে পাঠাল। একে তো গরমে বেহাল দশা, তার ওপর অফিসে এসে একটু বসতেও পারল না। মিমির মুখ গরমে লাল হয়ে আছে। ডেকেছে যখন না যেয়েও উপায় নেই। অগত্যা মিমি কাইফের কেবিনের দিকে এগিয়ে গেল। নক করার পরপরই অনুমতি পেল। ভেতরে প্রবেশ করে বরাবরের মতো কাইফকে ল্যাপটপে মুখ গুজে থাকতে দেখা গেল। সে মিমির দিকে না তাকিয়েই বলল —

— আপনি আজ দশ মিনিট লেট করেছেন মিস মিমি।

মিমি হতবাক! মাত্র দশ মিনিট লেট হয়েছে। এ আবার কে ধরে? সে তো ইচ্ছে করে দেরি করেনি। জ্যামের কারনে দেরি হয়ে গিয়েছে। মিমি কাচুমাচু হয়ে বলল–

— ইয়ে মানে স্যার!

কাইফ তাকে থামিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল–

— লেট যখন করেছেন তখন শাস্তি তো পেতেই হবে মিস মিমি।

মিমি কি বলবে? শাস্তি যখন পেতেই হবে তাহলে চুপ থাকাই শ্রেয়। কাইফ তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল–

— আপনার শাস্তি এই যে আপনি স্টোর রুম পরিষ্কার করবেন। একদম চকাচক করে দেবেন।

মিমি ভড়কে গেল। এ কেমন শাস্তি? শেষ মেষ স্টোর রুম? মিমি মিনমিন করে কিছু বলতে নিলেই কাইফ বলে উঠল–

— উহু! কোনো কথা নয়। যা বলেছি তাই-ই করতে হবে। পিওন আপনাকে দেখিয়ে দেবে। যান আর দ্রুত পরিষ্কার করে ফেলুন। আমি কিন্তু সব দেখব।

মিমি মুখ গোমড়া করে বের হয়ে গেল। এমন বিচিত্র ধরনের শাস্তি তাকে কেন দেওয়া হলো? সে জানে না। পিওনের থেকে স্টোর রুম দেখে নিল। স্টোর রুমের অবস্থা দেখে তার মাথায় হাত। এত্তো ধুলো পরিষ্কার করতে গেলে সে নিশ্চিত ধুলো রাজ্যের রানী হয়ে যাবে! কপাল! সবই কপাল! সে কোমরে ওড়না গুজে সে কাজে লেগে পড়ল।

কাইফ ল্যাপটপে বসে মিমিকে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। সেদিন যে মিমি আদিলের সাথে কথা বলেছিল, এটা তার একদমই পছন্দ হয়নি। কেন মিমি অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে হেসে কথা বলবে? তাই সে আজ মিমিকে এমন ধরনের কাজ দিল। যেন সে কাজে ব্যস্ত থাকে আর আদিলের সাথে কথা বলতে না পারে। কাইফ যে কাজ ছাড়া এক মূহূর্ত বসে থাকে না, সে দিব্যি বসে বসে মিমিকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল।

ধুলোর মধ্যে মিমির যায় যায় অবস্থা। কাশতে কাশতে নেতিয়ে পড়ছে সে। তবুও কাজ করে যাচ্ছে। একটা জেদ পুষে রেখেছে, ধুলোর মধ্যে কাশতে কাশতে শহীদ হয়ে গেলেও সে কাজ থামাবে না। কাইফের খোটা দেওয়া কথা বার্তা মোটেও শুনবে না। সে শেলফ্ ঝেড়ে ঝুড়ে পরিষ্কার করছে। পিওন বেচারা অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। সে মিমিকে সাহায্য করতে চায়লেও পারছে না। কারন কাইফের কড়া নিষেধ! কেউ যেন মিমিকে সাহায্য না করে। কিন্তু পিওনের খুবই মায়া হচ্ছে। সে মিমিকে বলল–

— আপনি আমাকে দেন ম্যাডাম আমি করে দিচ্ছি।

মিমি খুক খুক করে কেশে বলল–

— আপনি চলে যান ভাই। আমি করে নিতে পারব।

— কিন্তু ম্যাডাম!

— আমি বলছি তো পারব। আপনার আরও কত কাজ আছে সেগুলো করুন।

পিওন বাধ্য হয়ে চলে গেল। মিমি একটা টুলের ওপর উঠে দাঁড়াল। উদ্দেশ্য উঁচু শেলফ্ পরিষ্কার করা। একহাতে নাক মুখ ঢেকে এক হাতে পরিষ্কার করছে। হঠাৎ মনে হলো টুলটা নড়ছে। মিমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধপ করে পড়ে গেল। ভয়ে সে চোখ খিচে বন্ধ করে রেখেছে। এই বুঝি কোমরটা ভাঙল! কিছুক্ষণ পার হয়ে গেল মিমি কোনো ব্যথা অনুভব করল না। সে অবাক হলো। এতোক্ষণে তো কোমর ভেঙে গুড়ো হয়ে যাবার কথা। সে পিটপিট করে চোখ খুলে কাইফের গম্ভীর মুখের দর্শন পেল। মিমি ভড়কে গেল। কাইফ তাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মিমি বিস্ময়ে হতবাক। কাইফ তাকে দাঁড় করিয়ে দিল এক ধমক–

— গর্দভ! মাথার ভেতরে কিছু আছে নাকি খালি? টুলটা যে আধভাঙা সেটা দেখতে পাননি? না দেখেই দাঁড়িয়ে পড়লেন? পড়ে গেলে কোমর ভেঙে বাড়িতে বসে থাকতে হতো।

মিমির রাগ হলো। কাইফ তাকে গর্দভ বলল! একে তো নিজেই তাকে এই কাজ দিয়েছে এখন আবার ধমকাচ্ছে। সে নাকের পাটা ফুলিয়ে বলল–

— পড়ে গেলে যেতাম। কোমর ভাঙলে ভাঙতো। আপনাকে কে ধরতে বলেছিল?

কাইফ বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেল। সে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল–

— আপনি পড়ে গেলে তো আমাকেই ছুটি দেওয়া লাগত। আপনি আমার পিএ আপনাকে ছুটি দিলে আমার অনেক সমস্যা। নাহলে আমার খেয়ে দেয়ে কাজ নেই আপনাকে ধরতে যাব।

মিমি মুখ বাঁকিয়ে বিড়বিড় করে বলল–

— তাই তো বলি! আমাকে কেন ধরতে যাবেন? কাজ ছাড়া তো আপনার মগজে কিছুই ঢোকে না। বদ লোক কোথাকার।

কাইফ তার কথা শুনল না। সে আবারও বলল–

— অনেক হয়েছে পরিষ্কার করা। এবার হাত মুখ ধুয়ে আমার কেবিনে আসুন, কাজ আছে।

বলেই সে লম্বা লম্বা পায়ে চলে গেল। মিমি মুখ ভেংচি কেটে বলল–

— অ্যাহ! কাজ আছে।

সে ধীর পায়ে বের হয়ে গেল। মনে মনে কাইফকে হাজার বকা দিতে ভুলল না।

কাইফ ল্যাপটপে দেখেছিল মিমির টুলটা নড়ছে। সে তৎক্ষণাৎ স্টোর রুমে ছুটেছিল। ঠিক সময়ে যেয়ে না ধরলে বড় একটা কান্ড ঘটিয়ে বসত মিমি। মেয়েটা এতোটা কেয়ারলেস কীভাবে হতে পারে? কাইফ বুঝতে পারে না।
————

মিমি গালে হাত দিয়ে বসে আছে। নিশান তার সামনে বসে আঁকি বুকি করছে। সে আজ পড়বে না। মানে কিছুতেই পড়বে না। বিভিন্ন জিনিস আঁকবে আর মিমিকে বলতে হবে যে সে কি এঁকেছে। মিমির মনে হচ্ছে এর থেকে কচু গাছে ঝুলে পড়া ভালো। গোল গোল লম্বা লম্বা দাগ এঁকে বলছে ‘বলো তো এটা কি এঁকেছি?’ মিমি জোর পূর্বক হেসে কিছু একটা বলে দেয়। কিন্তু তার কথা মেলে না, তখন নিশান বিজ্ঞদের মতো বলে–

— তুমি দেখি কিছুই পারো না রসমালাই। আমি কত সুন্দর আঁকছি আর তুমি বলতেই পারছ না।

তার ভাবনার মাঝেই নিশান বলে উঠল–

— তোমার কি ঘুম আসছে রসমালাই?

মিমি হকচকিয়ে গিয়ে মাথা নাড়িয়ে বলল–

— না তো।

— আচ্ছা। দেখো আমি কি এঁকেছি।

বলে সে খাতা এগিয়ে দেয়। মিমি বিড়বিড় করে বলল–

— অফিসে এর মামা জ্বালায় আর এখানে এ। মামা ভাগ্নে মিলে আমাকে জ্বালিয়ে খেল।

নিশান গোল গোল করে তাকিয়ে বলল–

— তুমি বিড়বিড় করে কি বলছো রসমালাই?

— কিছু না নিশান।

সে খাতার দিকে তাকিয়ে দেখে ছোট ছোট গোল আঁকা। মিমির মনে হলো তার কাছে কাইফের চশমাটা থাকলে মন্দ হতো না। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। সে বলল–

— আমি বুঝতে পারছি না নিশান। তুমি কি এঁকেছ?

নিশান মাথা দুলিয়ে বলল–

— তুমি এটাও পারলে না? এই দেখো আমি রসমালাই এঁকেছি। রসমালাই তো এমন হয় গোল গোল।

মিমির ইচ্ছে করল দেওয়ালে মাথা ঠুকে পটল তুলতে। সে মেকি হেসে বলল–

— ওহ! আমি বুঝতে পারিনি।

নিশান আবারও নিজের আঁকা আঁকিতে মন দেয়। মিমি কি করবে? সে পুনরায় গালে হাত দিয়ে বসে রইল। সময় শেষে ঈশানি আজ তাকে চেপে ধরল। আজ গল্প করেই তারপর যেতে হবে। মিমি বাধ্য হয়ে রাজি হলো। বিভিন্ন নাস্তা সাজিয়ে ঈশানি গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসল। মিমির মনে হলো ঈশানি অধিকাংশ সব গল্প কাইফকে নিয়ে। এক পর্যায়ে ঈশানি বলল–

— জানো মিমি? আমাদের লাভ ম্যারেজ।

মিমি উৎসাহিত হয়ে বলল–

— সত্যি! তাহলে আপনার লাভ স্টোরি শোনান আপু।

— নিশানের পাপা আমাকে নাকি প্রথম দেখাতেই ভালোবেসে ফেলেছিল। ও ছিল আমার ভার্সিটির সিনিয়র, মাস্টার্স পড়ত আর আমি সবে মাত্র অনার্স ফার্স্ট ইয়ার। সে আমার পিছু পিছু ঘুরত। নানা বাহানায় আমার সামনে আসত। এমনকি আমার ক্লাসের আশে পাশেও ঘুর ঘুর করত। অথচ ওর ক্লাস ছিল অন্য ভবনে। একদিন তো আমাকে প্রপোজ করেই দিল। কি দিয়ে প্রপোজ করেছিল জানো?

মিমি মাথা নাড়িয়ে বলল–

— কি দিয়ে?

— একটা বেলি ফুলের মালা দিয়ে। সেটা আমার হাতে পরিয়ে দিয়েছিল।

বলেই ঈশানি লাজুক হাসে। মিমি ঈশানির লাজুক হাসি দেখে নিজেও হাসে। ঈশানি আবারও বলা শুরু করল–

— সেই থেকে আমাদের প্রেম শুরু। ও মাস্টার্স শেষ করার পর পরই চাকরি পেয়ে গেল। ব্যস আর পায় কে? সোজা বাবা মা নিয়ে আমাদের বাড়িতে চলে গেল। সে একটুও অপেক্ষা করতে চায় না। তার পাগলামী দেখে আমার বাবা মা বাধ্য হয়ে রাজি হয়েছিল। তারপর আর কি? হয়ে গেল বিয়ে।

মিমির ঈশানির কাহিনী খুবই ভালো লাগল। সে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল অনেক বেজে গিয়েছে। সে বলল–

— আপনার লাভ স্টোরি শুনে অনেক ভালো লাগল আপু। আজ তাহলে আমি উঠি? অনেক বেজে গিয়েছে।

ঈশানি সম্মতি দিয়ে বলল–

— আচ্ছা যাও। সাবধানে যেও।

মিমি মুচকি হেসে ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে গেল।

চলবে?

#হতে_পারি_বৃষ্টি
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ২৩

বন্ধুত্ব এক পবিত্র সম্পর্ক। সত্যিকারের বন্ধু পাওয়া খুবই ভাগ্যের ব্যাপার। যারা এমন বন্ধু পেয়েছে তার নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান অথবা ভাগ্যবতী। এই যেমন মিমি পেয়েছে তানিয়াকে আর তানিয়া পেয়েছে মিমিকে। বলতে গেলে ছোট বেলা থেকেই তাদের বন্ধুত্ব। মিমি ছিল ক্লাসের চুপচাপ মেয়ে আর তানিয়া ছিল তার ঠিক বিপরীত, চঞ্চল। মিমি যখন নতুন নতুন স্কুলে গেল তখন সে চুপ করে এক কোণে বসে থাকত। না কারোর সাথে কথা বলত আর না কেউ তার সাথে। একদিন তানিয়া তার সাথে কথা বলল, তার পাশে বসল এমনকি নিজের টিফিনও শেয়ার করল। তানিয়ার অতিরিক্ত কথা বলাতে মিমি প্রথম প্রথম বিরক্ত হতো। কিন্তু সেই বাঁচাল মেয়েটাই কীভাবে যেন তার জানের জিগার হয়ে গেল। তানিয়ার বক বক মিমি খুবই উপভোগ করত। মিমিকে কেউ কিছু বললে তানিয়া তাকে আচ্ছা করে ধুয়ে ছেড়ে দিত। এমনই তাদের বন্ধুত্ব। একে অপরের জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত।

সেই তখন থেকে তানিয়া গুন গুন করে কেঁদে যাচ্ছে। মিমি কানে ফোন ধরে রেখেছে। অনেক বার কাঁদতে বারন করেছে কিন্তু তানিয়া শুনলে তো? সে তার মতো গুনগুনিয়ে যাচ্ছে। মিমির এখন কি করা উচিত? সেদিনের ঘটনার জন্য তানিয়া নিজেকে দোষী ভাবছে। তার ভাষ্যমতে তানিয়া যদি মিমিকে দেখে শুনে রাখত তাহলে সেই ঘটনা ঘটতো না। মিমি এতো বোঝাল যে তার দোষ নেই, তানিয়া শুনছেই না। মিমি অতিষ্ঠ হয়ে দিল এক ধমক–

— তানি! তুই থামবি নাকি আমি কল কেটে দেব?

তানিয়া নাক টেনে বলল–

— দে! কেটে দে। আমি কি বারন করেছি? আমি বারন করলেই বা কি? আমি তোর কে? আমি তোর কেউ না।

মিমি শান্ত কন্ঠে বলল–

— কাঁদিস না ইয়ার! তুই কাঁদলে আমারও কান্না পায়। তুই জানিস না?

— এতোই যখন দরদ আমার ওপর তাহলে এ ক’দিন কথা বলিসনি কেন? ফোনটাও অফ করে রেখেছিলি।

মিমি কি উত্তর দেবে ভেবে পেল না। সে কথা ঘোরানোর জন্য বলল–

— মেঘ জিজু কোথায় রে? তুই কাঁদছিস আর সে কিছু করছে না?

— কথা ঘোরাচ্ছিস তাই না? মেঘ বাড়িতে নেই। থাকলে কি আমি একটু শান্তিতে কাঁদতে পারি? ব্যাটা চোখের নিচে পানি দেখলেই হাউমাউ শুরু করে। আরে বাবা আমি কি একটু ঘামতেও পারি না? চোখের নিচে পানি থাকলেই কি কাঁদা হয়ে গেল?

তানিয়া কথা শুনে মিমি মৃদু শব্দে হাসে। তানিয়া মেকি রাগ দেখিয়ে বলল–

— হাসবি না একদম। আমি মরছি আমার জ্বালায়।

— মেঘ জিজু তোকে কত্ত ভালোবাসে ইয়ার! আজ কাল এমন ভালোবাসা দেখা যায় না কিন্তু।

— দোয়া করি তোর লাইফেও এমন কেউ আসুক যে তোকে অনেক অনেক ভালোবাসবে, মেঘ আমাকে যতটা ভালোবাসে তার থেকেও বেশি। তখন বুঝবি মজা।

‌মিমি হাসে। তানিয়া আবারও বলল–

— তোকে অনেক মিস করছি মিমু। একটা বার এ বাড়িতে আয় না?

ও বাড়ি মানে তানিয়ার শশুর বাড়ি। মিমি আপাতত সেখানে যেতে চাইছে না। সে বলল–

— আর কদিন পর সেমিস্টারের ফাইনাল পরীক্ষা। তখন দেখা হবে তো। নাকি তুই পরীক্ষা দিবি না?

— আরে পরীক্ষা দেব না কেন? বিয়ে হয়ে গিয়েছে বলে পড়ালেখা বাদ দেব নাকি? টেনেটুনে পাস করতে পারলে হবে। তোর চাকরি কেমন চলছে মিমু?

মিমি মনে মনে ভাবে ‘আর চাকরি! তোর ষাঁড় টাইপের ভাসুর আমাকে খাটিয়ে মারে। ব্যাটা বদলোক একটা! ইচ্ছে করে আমাকে বেশি বেশি কাজ দেয়। আবার তার সামনে বসে কাজ করতে হবে। একটু যে ফাঁকি দেব তারও উপায় নেই।’ মুখে বলল–

— হ্যাঁ, ভালোই চলছে।

অতঃপর কাজের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে তারা কিছুক্ষণ হাবি জাবি বকাবকি করল।
————-

— হেই মিমি!

আদিলের কন্ঠে মিমি মাথা তুলে তাকায়। সে বর্তমানে ক্যান্টিনে বসে আছে। এখন লাঞ্চ টাইম চলছে। মিমি সৌজন্যতার হাসি হেসে বলল–

— হ্যালো স্যার! বসুন না?

মিমির বলতে দেরি ধপ করে আদিলের বসতে দেরি হলো না। সে বলল–

— বুঝলে মিমি? আজ একটা বউ নেই বলে আমি খুবই অসহায়।

মিমি ভ্রু কুঁচকে বলল–

— কেন স্যার?

— এই যে কেউ জান,জামাই বলে ডাকে না। সকালে মিষ্টি কন্ঠে ডেকে ঘুম ভাঙিয়ে দেয় না।

তার কন্ঠে আফসোস। মিমি ঠোঁট টিপে হাসে। আদিল আবারও বলল–

— রাস্তা ঘাটে কত তাকাতাকি করি জানো? যদি মনের মতো একজনকে পেয়ে যাই? পেয়ে গেলেই তুলে নিয়ে বিয়ে। নিজের ঘটকালি নিজেই করব। বুদ্ধিটা কেমন বলো?

মিমি হাসি চেপে রাখতে পারে না। খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল–

— অনেক ভালো বুদ্ধি স্যার। আমার শুভকামনা রইল আপনার সাথে। খুব শীঘ্রই পেয়ে যাবেন তাকে।

— থ্যাঙ্কিউ মিমি। তুমি শুভকামনা দিয়েছ এবার আমি নিশ্চয় তাকে খুঁজে পাব।

তাদের কথার মাঝেই পিওন এসে হাজির। মিমিকে বলল–

— ম্যাডাম স্যার কেবিনে যেতে বলেছেন।

মিমি অবাক হলো। এখনও লাঞ্চ টাইম শেষ হয়নি। তাহলে কাইফ ডাকছে কেন? এমন প্রশ্ন মনে রেখেই সে আদিলের থেকে বিদায় নিয়ে অগ্রসর হলো। কেবিনে নক করে প্রবেশ করতেই আচমকা আক্রমণের হতবাক হয়ে গেল। কাইফ তার দুবাহু শক্ত করে ধরে দেওয়ালে ঠেসে ধরেছে। কাইফের রক্তলাল চোখ দেখে মিমির ছোট্ট হৃদয়ে কম্পনের সৃষ্টি হলো। কাইফের ঘন ঘন উষ্ণ নিঃশ্বাস তার মুখশ্রীতে আছড়ে পড়ছে। মিমি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে আওড়াল–

— স স্যার?

আক্রোশে ফেটে পড়ল কাইফ। হিসহিসিয়ে বলল–

— এতো কথা, এতো হাসাহাসি কিসের আদিলের সাথে?

মিমি চমকে কথা বলতেই ভুলে গেল। কাইফ তার দিকে আরেকটু এগিয়ে বলল–

— আমার সামনে তো হাসো না। আদিলের সাথে হাসাহাসি কিসের জন্য?

মিমি অনুভব করল তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কাইফ এভাবে কখনও তার সাথে কথা বলেনি। এভাবে কাছেও আসেনি। এতো কাছে আসার যেন মিমি বোবা হয়ে গেল। কি বলবে মিমি? মিমি বলার চেষ্টা করল–

— স স্যার! কি ব বলছেন আপনি? আ আপনি কি ঠ ঠিক আছেন?

কাইফ মিমিকে ছেড়ে দিল। রাগের বসে কি একটু বেশি রিয়াক্ট করে ফেলল? সে মিমির দিকে পিঠ করে জবাব দিল–

— আমি ঠিক আছি।

এতক্ষণে মিমির জান ফিরে আসলো। কাইফ যেন তাকে চেপে মেরেই ফেলছিল। সে বলল–

— আপনি লাঞ্চ করেছেন স্যার?

কাইফ শক্ত কন্ঠে উত্তর দিল–

— না।

মিমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে টিফিন বক্স থেকে খাবার প্লেটে সাজিয়ে দিল। প্রায় রোজই কাইফের বাড়ি থেকে খাবার আসে। কাইফ সোফায় বসে আছে। মিমি তার সামনে খাবার রেখে বলল–

— খেয়ে নিন, স্যার।

— খাবো না।

মিমি কাইফের হাত ধরতে গেলেই ডান হাতের কেটে যাওয়া অংশ তার চোখে পড়ল। মিমি হকচকিয়ে ভালো করে ধরে দেখল। অনেকখানি কেটে আছে। সে চিন্তিত কন্ঠে বলল–

— হাত এতোটা কীভাবে কেটেছে মিস্টার খান?

কাইফ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। মিমি তাকে স্যার ব্যতিত অন্য কিছু সম্বোধন করল আজ প্রথম। মিমি রাগ দেখিয়ে বলল–

— কি হলো মিস্টার খান? বলছেন না কেন?

কি বলবে কাইফ? আদিলের সাথে মিমিকে হাসতে দেখে সে কাঁচের গ্লাস হাত দিয়ে চেপে ধরেছিল। তাই এই অবস্থা। মিমি ফার্স্ট এইড বক্স এনে কাইফের হাত ব্যান্ডেজ করে দিল। কাইফ নির্বাক হয়ে দেখে গেল। কাইফ এই হাত দিয়ে তো আর খেতে পারবে না। মিমি একটা চামচে করে খাবার তুলে ধরে কাইফের সামনে। কিন্তু কাইফ মুখে নেয় না। মিমি ইতস্তত করে বললো–

— আপনি হাত দিয়ে খেতে পারবেন না। তাই আমি..

— চামচটা ফেলে দিন।

মিমি হকচকিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো–

— জ্বি?

— চামচ ফেলে দিয়ে আপনার হাত ব্যবহার করুন। নাহলে দরকার নেই।

মিমি ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে নিজের হাত ধুয়ে ভাত মেখে কাইফের মুখের সামনে এগিয়ে দিল। কাইফ মিমিকে দেখে যাচ্ছে এক দৃষ্টিতে। মিমি চোখের ইশারায় তাকে খাবার মুখে নিতে বলল। কাইফ ভদ্র ছেলের মতো খেয়ে নিল। পুরোটা সময় সে মিমির দিকে তাকিয়ে ছিল। এতে মিমির অস্বস্তি হলেও সে পাত্তা দিল না। খাওয়ানো শেষে মিমি বলল–

— এমন কেয়ারলেস হলে হবে মিস্টার খান? দেখুন তো হাতের কি অবস্থা হয়েছে? এখন এই হাত দিয়ে আপনি কাজ করবেন কীভাবে যেটা ছাড়া আপনার চলে না। আর খাবেনই বা কীভাবে?

কাইফ বিড়বিড় করে বলল–

— আপনিই নাহয় সব কিছুর দায়িত্ব নিয়ে নিন।

মিমি শুনতে না পেয়ে বলল–

— কিছু বললেন মিস্টার খান?

— হ্যাঁ। তখন থেকেই আমাকে মিস্টার খান বলে যাচ্ছেন। আগে তো কখনও বলেননি।

মিমি লজ্জা পেল। সে কাইফের চিন্তায় কি থেকে কি বলে ফেলেছে টেরই পায়নি। কাইফ মিমির ধীরে ধীরে লাল হওয়া গালের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকল। মিমি নিচু কন্ঠে জবাব দিল–

— স্যরি মিস্টার খান! আই মিন স্যার ‌। কি বলতে কি বলে ফেলেছি।

মিমি এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে কেবিন থেকে বের হয়ে গেল। তার বুকের মধ্যে দুরুদুরু করছে। কাইফ সেদিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। সে সত্যিই এই মেয়ের ওপর ধীরে ধীরে দূর্বল হয়ে পড়ছে। তলিয়ে যাচ্ছে অতল গহ্বরে। কেউ তাকে বাঁচাতে পারবে না, কেউ না।


চলবে?
{ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন, ধন্যবাদ।}