হৃদমাঝারে শুধুই তুই পর্ব-০৮

0
400

#হৃদমাঝারে_শুধুই_তুই
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-৮

হাত পা বাধা অবস্থায় বসিয়ে রাখা হয়েছে আমাকে।ভয় আর বিস্ময় নিয়ে সামনের মানুষগুলোকে দেখে চলেছি।সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত।আমার ক্যামেরাটা সামনেই কাঠ জরো করে লাগানো আগুনের ধারে পরে আছে।পাশেই একটা সাউন্ড সিস্টেমে ফুল সাউন্ডে উলুধ্বনির শব্দ বাজানো হচ্ছে।যা ভেবেছিলাম,তা একদমই নয়।এমনটা হবে তা কল্পনাতেও ছিলো না আমার!মামার বর্ননা অনুযায়ী,এবার সত্যিই আমাকে গায়েব করে দিবে এরা।এতোটা আন্ডারেস্টিমেট করা,আর অতিরিক্ত কৌতুহল দেখানোর ফল হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি আমি!এবার আর বাচার কোনো পথই নেই তা বোঝা শেষ আমার!

ঘাপটি ‌মেরে জঙ্গলের ধারে বসে ছিলাম সেই উলুধ্বনির আশায়।টর্চটা অফ করে দিয়েছিলাম।নুপুরের আওয়াজ আসছে না আর।তারমানে শিমুল চলে গেছে আর আরমানরাও ফিরে এসেছেন।বসে বসে তারা গুনছিলাম আর ক্যামেরা ফিরে পাওয়ার ছোটখাট সেলিব্রেশন হিসেবে গুনগুনিয়ে গান গাচ্ছিলাম।এটা যে জঙ্গল,সময়টা যে মধ্যরাত,মাথায় আসেনি একটাবারও আমার।হঠাৎ কোথাও থেকে সমস্বরে ভেসে আসে উলুধ্বনি।চকচকে চোখে উঠে দাড়ালাম।চাদের আলো বর্তমান,তবে তা লাগবে না আমার।নাগরশাল দেখার আনন্দ সবকিছুকে ছাপিয়ে যাচ্ছে।মুখটা ওড়নায় বেধে পা বাড়ালাম সেই শব্দকে অনুসরন করে।জানিনা কতোক্ষন থাকবে,যদি আমি পৌছানোর আগেই শব্দ থেমে যায়?না না।তাহলে তো আর খুজেই পাবো না।তাই এক পর্যায়ে দৌড় লাগালাম।

দৌড়াতে গিয়ে একসময় দড়ির মতো কিছুতে পা আটকে যায় আমার।সাথে সাথে বাধন পরে যায় পায়ে।বুঝতে পারলাম ওটা ফাদ টাইপের কিছু ছিলো।কিন্তু কার জন্য?কে রেখেছে?বসে পরেছিলাম,পায়ের বাধন খোলারও চেষ্টা করছিলাম,কিন্তু অসম্ভব বাজেভাবে পা আটকে গিয়েছিলো আমার।আর কিছু করে ওঠার আগেই ইয়া লম্বা লম্বা দুজন মানুষকে সামনে দেখতে পেলাম।টর্চের অল্প আলোতে না বুঝলেও,চাদের আলোতে তাদের অবয়ব দেখে ভয় পেয়ে গেলাম।একদম কালো বর্নের,ইয়া লম্বা।যাকে বলে নিগ্রোদের মতো দেখতে।আমি কিছু বলার আগেই ওরা একজন মুখে কাপড় বেধে মুখ আটকে দেয় আর আরেকজন আমাকে কাধের উপর তুলে হাটা লাগায়।হাত পা ছোড়াছুড়ি করতে গেলেই হাত বেধে দেয় আর এখানে এনে পা টাও বেধে বসিয়ে দেয়।

আমি সরু চোখে সবটা পর্যবেক্ষন করছি।এদের বেশভুষায় কোনোভাবেই মনে হচ্ছে না এরা আদিবাসী।কিন্তু মামাতো হিডেন ট্রাইবস্ই বলেছিলো।আর এসব সাউন্ড সিস্টেমে উলুধ্বনি বাজানোর মানে কি?এরমধ্যে একজন এসে আমার কাছে এসে হাটু গেরে বসে বললো,

-হোয়াটস্ আপ?

হোয়াটস্ আপ?কোথাকার কোন উগান্ডাবাসী!আবে তোর ইয়ার লাগি আমি?তো এম্নে বাধলি ক্যান আমারে?দুটো সেলফি তুলতেই তো আসছিলাম!

-তা বাচ্চা মেয়ের এতো সাহস কোথ্থেকে আসলো?

ওর মুখে খাটি বাংলা শুনে আমার আকাশ থেকে পরা অবস্থা।হা করে তাকিয়ে আছি।

-ডোন্ট গেট শকড্!আমরা অনেকদিন হলো এখানে আছি।বাংলা বলাটা অতোটাও শকিং না।বাট ইউ মেড মি শকড্!

আমি নির্বাক হয়ে তাকিয়েই আছি।লোকটা আবারো চিন্তার ভাব ধরে বললো,

-নিজেকে সাহসী ভাবা ঠিকাছে,তা বলে এই বয়সে এতোটা সাহস দেখানো?

হেসে একটা তালি বাজিয়ে বুকে হাত গুজে বললো,

-আ’ম ইমপ্রেসড্!!!

আরেকজন এগিয়ে এসে বললো,

-এটাকে কি করবে বস?

লোকটা বাকা হাসলো। বললো,

-আগে এর এতো সাহসীকতার হিস্ট্রি তো শুনি।হ্যাঁ বলো!কেনো এসেছিলে?

…..

-সি,ইফ ইউ ওয়ান্ট,তুমি এই কথা বলার অজুহাতে আরো কিছু সময় বেচে থাকতে পারবে।অঅঅঅর,,,!

এখানে আমার বাচা মরার প্রশ্ন তারমানে।”মিথি,যাবতাক তেরে মু চালেগি,তেরে সাসে চালেগি”!
আমাকে চুপ থাকতে দেখে লোকটা একটু ধমকে বললো,

-আই ওয়ান্ট মাই আন্সার!

কাপাকাপা গলায় বললাম,

-ন না নাগর শ্ শাল দ্ দেখতে।

লোকটা হু হা করে হেসে উঠলো।তারপর একটু হাসি থামিয়ে বললো,

-শুধুই দেখতে?

ঘাড় নাড়িয়ে হ্যাঁ বললাম।আশেপাশে আরো বিশ পচিশ জন হবে।কেউ আমাদের খেয়ালে নেই।কেউ বক্স হাতে এদিক ওদিক যাচ্ছে আর কেউ কেউ খুতিয়ে খুতিয়ে সে বক্সগুলো দেখছে।বক্সের সাথে কিছু বড়বড় বন্দুকও আছে।সে লোকটা আবারো হেসে বললো,

-তা কি কি দেখলে?

আমি চুপই রইলাম।লোকটা বললো,

-কনফিউসড্?

আবারো ঘাড় নাড়লাম।

-ওয়ানা নো?

এবার মুখে হুম বললাম।উনি হাসলেন আবারো।বললেন,

-কেনো জানি না আজ তোমাকে ক্লিয়ারলি বুঝিয়ে তারপর তোমার ব্যবস্থা করতে ইচ্ছা করছে।আফটার অল,এখানে যেচে মরতে আসাদের মধ্যে ইউ আর দ্যা ইয়াঙ্গেস্ট ওয়ান!

মরতে আসা?কথাটা শুনে শুকনো ঢোক গিললাম।কালো চেহারার লোকটা সবগুলো সাদা দাত বের করে হেসে বললো,

-এটা নাগরশাল টাগরশাল কিছু না,চোরাচালানের একটা বড়সর ঘাটি।চোরাচালান!ইউ নো?দেশি অস্ত্রসস্ত্র,টিএনটি,ড্রাগস্!আমরা মুলোতো আফ্রিকান।এদেশে এসবের কাজগুলো ভালোভাবেই করা যায় এটা জানতাম,কিন্তু কুসংস্কারের ভয় দেখিয়ে এতোটা ভালোভাবে,তা জানতাম না।উলুধ্বনির সিস্টেমটা তো দেখলেই,কি করি আমরা সেটাও জানলে,বাকিরা বা তুমি কিভাবে ধরা পরলে সেটাও বুঝেছো।নাও সি,এভাবে তোমাদের মতো আসা আনএক্সপেক্টেড,আনইনভাইটেড গেস্টদের কিভাবে আপ্যায়ন করি আমরা!

ভয়ে হাত পা অবশ হয়ে আসছে আমার।বেশিই বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি।এরা তো খুবই ডেন্জারাস!তাহলে কি মৃত্যুই এখন আমার পরিনতি?

-ওয়েট ওয়েট!বিফোর দ্যাট!তোমার চেহারাটা তো দেখি!মনুমেন্টাম বানাবো একসময়।সবচেয়ে কনিষ্ঠ,সাহসী,মেয়ে,,,আই হ্যাভ এভার সিন!হোয়াট সে?

কথাটা বলে লোকটা আমার ওরনায় হাত লাগালো।চোখ বড়বড় করে তাকালাম আমি।লোকটা একটু থেমে বললো,

-হেই!উইল ইউ স্ক্রিম?চেচাবে তুমি?লিসেন,কেউ কিন্তু শুনতে পাবে না বা বাচাতে আসবে না তোমাকে।বাট আই কান্ট টোলারেট নয়েজ।সো কিপ কাম এন্ড কোয়ায়েট,হুম?

আমি তৈরী হলাম সর্বোচ্চ কম্পাঙ্কের শব্দে চেচানোর জন্য।আজ চেচাবো,যতো জোরে পারি।এভাবেও মরন,সেভাবেও মরন।এর কান ফাটিয়ে দিয়েই মরবো।লোকটা আবারো মুখের ওড়না ধরতেই অন্য একজন লোক হাক ছাড়লো,

-বস!হেয়ার গট সাম এডাল্ট্রেট ড্রাগস্!

আমার সামনের লোকটা কপাল ভাজ করে সেদিকে তাকালো।তারপর আঙুল ভাজ করে দেখিয়ে বললো,

-জাস্ট আ মিনিট!

বলে উঠে গেলো।আমি দম নিলাম।নাহ্!এ সময়ে এতোটা স্ট্রেস নিলে চলবে না।পালাতে হবে এখান থেকে আমাকে।যা করার মাথা ঠান্ডা করে করতে হবে।আর এখনই মুখ্যম সুযোগ!আশেপাশে ভালো করে তাকালাম।পাহাড়া যে খুব বেশি জোরালো তা নয়!কারন হিসেবে পাতা ফাদগুলোর কথা মনে পরলো।পালাতে গেলে যদি আবারো ফাদে আটকা পরি!তাহলে তো আবার ধরে আনবে আমাকে!কিন্তু এখানে এভাবেও তো মৃত্যু অবধারিতো!তাই শেষ চেষ্টাটা করা যেতেই পারে।

ধীরে ধীরে বা পা আর হাত একসাথে করলাম।জুতার ভেতর ছুড়ি এনেছিলাম বিপদের বন্ধু হিসেবে।কে জানতো এতোবড় বিপদ আছে এখানে!যাই হোক,এখন এটা দিয়েই কাজ চালানোর চেষ্টা করতে হবে।ছুড়িটা বের করে হাত বাধা দড়িটা কাটতে শুরু করলাম।খুব তাড়াতাড়িই কেটে গেলো ওটা।সামনে হাত বের করতে যাবো তখনি দেখি পাশের একজন তাকিয়ে আছে আমার দিকে।হাতটা এমনভাবে রাখলাম যাতে মনে না হয় ওতে বাধন নেই।পা টা পিছিয়ে নিয়ে পিছন থেকেই উল্টোভাবে পায়ের বাধন কাটতে লাগলাম।না দেখে কাটতে গিয়ে পাও কেটে গেছে আমার।একসময় বুঝলাম পায়ের বাধনটাও কাটা শেষ।একটু দম নিলাম এবার!

চারপাশের লোকদের ব্যস্তই দেখলা‌ম।বিরবির করে নড়েচড়ে আগে ক্যামেরাটা পা দিয়ে এগিয়ে আনলাম,হাত পেছনে রেখেই।তারপর সুযোগ খুজতে লাগলাম হাত বের করার।বেশ কিছুক্ষন ওভাবে থেকেও কোনো সুযোগই পেলাম না।এরমধ্যে সে লোকটাকে আবারো আমার দিকে আসতে দেখলাম।নাহ্!আর সময় নষ্ট করা চলবে না।দৌড় লাগানোর জন্য উদ্যত হলাম এবার।

হঠাৎই একটা বিকট শব্দ!!!লোকটা পিছনে ঘুরে তাকালো।ওখানকার প্রত্যেকের মতো আমিও সে শব্দের উৎস নিয়ে আশ্চর্য হয়ে তাকাচ্ছিলাম এদিক ওদিক।পরক্ষনেই মনে পরলো,এইতো সুযোগ!আর একমুহুর্ত দেরি না করে ফটাফট পিছন থেকে হাত বের করে একনাগাড়ে কতোগুলো ছবি তুলেই দৌড় লাগালাম পিছন দিক।

মাথার উপর পুরো আকাশ আলোয় ঝলমল করছে।উচু উচু গাছগুলোর ফাকে ফাকে নানা রঙের আলোর ফুলকি দেখা যাচ্ছে।তারমানে ওটা আতশবাজির আওয়াজ ছিলো।আলোতে ভরে উঠেছে আকাশ।এ জঙ্গলে এসময় আতশবাজি কে জ্বালাবে?মনে মনে শুকরিয়া আদায় করে পা চালালাম।কিন্তু পায়ের নিচের শুকনো পাতার শব্দ বেশিদুর যেতে দেয়নি আমাকে।ওরা টের পেয়ে যায় আর বন্দুক হাতে বেশ কয়েকজন দৌড়াতে থাকে আমার দিকে।ওদের পায়ের আওয়াজ শুনে বুঝছি,খুব একটা দুরুত্ব নেই আমাদের মাঝে।

জঙ্গলে এতোরাতে কেউ আসবে না আমাকে বাচাতে,তাই নিজেই নিজেকে বাচানোর জন্য সবটা দিয়ে চেষ্টায় ছিলাম।আকাশটা আবারো শুধু চাদের আলোতে ভরপুর।অভ্যেস আছে আমার এ আলো।কিন্তু ওরা ভালোভাবে দেখতে পারছিলো না আমাকে,তাই দুবার গুলির শব্দ পেলেও সেটা গায়ে লাগেনি আমার।সামনের গাছগুলো দেখে সাইড হয়ে দৌড়াচ্ছি শুধু।জানি না কোন পথে যাচ্ছি।একসময় কেউ একজন হাত ধরে টেনে আমাকে নিয়ে বসে যায়।চিৎকার করার আগেই মুখ চেপে ধরে আমার।

এই আবছা আলোতেও লোকটাকে চিনতে ভুল হয়নি আমার।এমন এক রাতেই তো,এমন চাদের আবছা আলোতে দেখেছিলাম তাকে।তবে সেদিনের সে গভীর দৃষ্টিতে আজ শুধুই চিন্তা আর ভয়।আমাকে আগলে রাখতে শশব্যস্ত সে।আমি হাতে থাকা ক্যামেরাটা আমাকে জরিয়ে থাকা তার হাতের ভাজে ধরিয়ে দিলাম।উনি আরো শক্ত করে জরিয়ে ধরলেন আমাকে।তার বুকে মুখ গুজে শুধু অস্ফুট স্বরে একবার বললাম,

-আরমান!!!

#চলবে…..